ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি  

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২১, ১৫ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৯:২৫, ১৫ মার্চ ২০২১
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি  

অনেক দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয় পানি। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার গুনারী গ্রামের ছবি

গর্ভবতী গৃহিণী বুলি বেগম (৪২) চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। ২০ কিলোমিটার দূরের দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তিনি সন্তান প্রসব করেন। সন্তানটি বেঁচে গেলেও, পথিমধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রক্ষা হয়নি বুলি বেগমের জীবন। হয়তো গ্রামে চিকিৎসাসুবিধা পেলে বুলি বেগমের এই পরিণতি হতো না- স্বামী মনিরুজ্জামান গাজী এমনটাই মনে করেন।

বুলি বেগমের মতোই মারাত্মক অবস্থা হয়েছিল আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের হালিমা বেগমের (২৩)। তবে অনেক চেষ্টায় তিনি বেঁচে গেছেন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাতের পরে এলাকা ছিল পানির নিচে। এর মধ্যেই হালিমার সন্তান প্রসবের সময় হয়। স্বামী দিনমজুর নূর ইসলাম গ্রামের ডাক্তারের কাছে যান। সমাধান মেলেনি। অবশেষে নৌকায় হালিমাকে নিয়ে তিনি যান নদীর ওপারে শ্যামনগর উপজেলার একটি ক্লিনিকে। মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যেই হালিমা মা হতে পারলেও নবজাতক নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত অসুখে পড়ে।

বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের খুলনা জেলার এই এলাকাটি বারবার দুর্যোগ কবলিত হওয়ায় বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। দুর্যোগে ভেঙে পড়েছে যাতায়াত ব্যবস্থা। বাড়ছে জমির লবণাক্ততা। একইসঙ্গে বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট। প্রান্তিক এলাকায় অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা তো রয়েছেই। বুলি বেগম এর একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা নেই। একই ছবি দাকোপ উপজেলার কালবগি গ্রাম, কয়রার হাজতখালী গ্রাম কিংবা আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এর উপর চিকিৎসার মতো জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত ব্যয় করা তাদের পক্ষে কঠিন।

 কয়েক মাইল হেঁটে এই শিশু দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে এনেছে। শিশুর স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই বাবা-মার

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের গুনারী, নলিয়ান, কালাবগি গ্রামগুলো থেকে চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র অনেক দূরে। ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক অথবা ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানুষের ভরসা নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় সড়ক পথে দাকোপ উপজেলা সদরে যাওয়া কঠিন। মুমূর্ষূ রোগী নিয়ে যাতায়াতে একমাত্র ভরসা নদী পথ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সম্ভব না হলে সেই বিভাগীয় সদর খুলনায় যেতে হয়। কালাবগি গ্রামের ফকিরকোনা এলাকার বাসিন্দা কুলসুম বেগম বলেন, ‘রাতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের বিপদের শেষ থাকে না। এখান থেকে শহরের ভালো ডাক্তারের কাছে রোগী পাঠানো খুবই কঠিন! যে কারণে অনেক সময় গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তখন মুমুর্ষূ রোগীর জীবন বাঁচানো যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের বন্দি করে রেখেছে।’

বেশি ঝুঁকিতে নারীরা

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি ঝুলন্ত গ্রামে নারীদের গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানে সমস্যার কথা জানালেন সেখানকার নারীরা। অন্য এলাকার অধিকাংশ নারীর প্রথম সন্তান গর্ভপাতের কারণে নষ্ট হয়েছে। অনেকে গর্ভপাতের কারণে দীর্ঘ সময় সন্তান নিতে পারছেন না। এই নারীদের একজন আশরাফুল সরদারের স্ত্রী সাজিদা বেগম (৩০)। অকাল গর্ভপাতের সঙ্গে লবণ পানির সম্পর্ক জানেন না এই নারীরা। অথচ তাদের লবণ পানির সঙ্গে বসবাস করতে হয়। শেফালি বেগম (৬০) একারণে হতাশার সুরে বলছিলেন, সারা জীবন এই লবণ পানির সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম। আমরা গরিব মানুষ। কোথায় যাবো? লবণ পানিতে কী হয় জানি না।

২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১২, ৮৬৭ জন গর্ভবতী নারীকে নজরদারিতে রেখেছিল ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। এদের মধ্যে উপকূলীয় এবং পাহাড়ি এলাকার নারীরা রয়েছেন। সমীক্ষায় ওই সংস্থাটি দেখতে পেয়েছে, পাহাড়ি বা উঁচু এলাকায় বসবাসকারী নারীদের তুলনায় উপকূলীয় এলাকায়, সমুদ্রের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী নারীদের গর্ভপাত হওয়ার প্রবণতা বেশি; যার হার ১১ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আপাতত পার্থক্যটি কম বলে মনে হলেও, সমুদ্রের কাছে সমতলে থাকা নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা বাড়ছে। তারা যে পানি খাচ্ছেন, তার মধ্যে কী পরিমাণ লবণ রয়েছে, তার ওপর এই পার্থক্যটি নির্ভর করে।

মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা এদের কাছে পৌঁছায় না। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আম্পান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ছবি

সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের ইম্পোরিয়াল কলেজের একদল গবেষকের ‘স্যালাইনিটি এন্ড মেটারন্যাল হেলথ’ শীর্ষক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দাকোপ উপজেলায় বর্ষাকালে প্রতিদিন গড়ে খাবারের পানি থেকে শরীরে সোডিয়াম প্রবেশ করে শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ২ গ্রাম। যা শুষ্ক মৌসুমে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ থেকে ১৬ গ্রাম। দাকোপ, কয়রা আশাশুনির স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এ সব এলাকায় প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মের হারও অপেক্ষাকৃত বেশি।

‘স্যালাইনিটি এন্ড মেটারন্যাল হেলথ’ শীর্ষক সমীক্ষার প্রজেক্ট ম্যানেজার আসমা বেগম শিল্পী বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে একটি ফলাফল আমাদের কাছে আছে। একজন স্বাভাবিক মানুষের শরীরে যতটুকু লবণ থাকার কথা, তার থেকে ৭ গুন বেশি লবণ পাওয়া গেছে। যেটা অনেক বেশি ভয়াবহ।’

দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনোলজির কনসালট্যান্ট ডা. সন্তোষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘এই অঞ্চলের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ লবণাক্ত পানি পান করছে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটা বড় সমস্যার কারণ। কেননা লবণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ছে। গর্ভবতী মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।’

লবণ পানির সঙ্গেই বসবাস। নেই যথাযথ স্যানিটেশন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্স-বাংলাদেশের ‘ইমপ্যাক্ট অব স্যালাইনিটি অন উইমেন হেল্থ ইন কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানি দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে নারীরা জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যা পরবর্তীতে ক্যানসারে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উপকূলীয় এলাকার অনেক নারী জীবিকা নির্বাহের জন্য নদীতে মাছ ধরতে যায়। নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ার কারণে তাদের যৌনাঙ্গে চুলকানিসহ অনেক রোগ দেখা দিচ্ছে। এসব এলাকার নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণ পানিতে ধুয়ে সেটি পুনরায় ব্যবহার করে। ফলে নানা ধরনের যৌনরোগে আক্রান্ত হয় তারা। চর্মরোগ, অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতার সমস্যাও এলাকায় রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোস্টাল লাইভলিহুড এন্ড এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন)-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদি বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে স্বাস্থ্যের ওপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। ২০০৩ এবং ২০১১ সালে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান জিইজএস-এর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দাকোপ অঞ্চলের মানুষেরা বিশেষত নারীরা ডাব্লিউএইচও নির্ধারিত যে লবণাক্ততা, তার চেয়ে ১৬ থেকে ২০ গুন বেশি লবণ শরীরে গ্রহণ করেন। ফলে এ অঞ্চলে গর্ভাবস্থায় সংকট এবং প্রি ম্যাচিউরড ডেথের পরিমাণ দেশের অন্যান্য স্থান থেকে ১৫ থেকে ২০ গুন বেশি।’

দূরত্ব স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ

কয়রা উপজেলার সর্বদক্ষিণের গ্রাম ঘড়িলাল। উপজেলা সদর থেকে গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এই গ্রামের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম সিকদার বলেন, ‘উপজেলা সদরে গিয়ে জরুরি চিকিৎসা নেওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। অধিকাংশ সময় আমাদের নৌ-পথে যাতায়াত করতে হয়।’

ঘড়িলাল বা হাজতখালী গ্রামের মতো একই চিত্র সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের। সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে ওই এলাকা ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে পানির নিচে ডুবে আছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র সবই পানির তলায় ছিল দীর্ঘদিন। এলাকার রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় ওই এলাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। উপজেলা সদর অনেক দূরে। পাশের উপজেলা শ্যামনগরে যেতেও একটি বড় নদী পার হতে হয়।

হাসপাতালের দূরত্ব ও লবণাক্ততার সমস্যা বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলজুড়ে বিদ্যমান। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত সেই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শুধু দূরে তাই নয়, আছে সেবার অপ্রতুলতা। কয়েকজন চিকিৎসক থাকলেও একজনও বিশেষজ্ঞ নেই। এমনকি সেখানকার একমাত্র এক্সরে মেশিনটিও নষ্ট। এই সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নারীরা। তাদের ভরসা গ্রাম্য চিকিৎসক।

খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার এস কে তোহিরুল হক বলেন, ‘যে কোনো মুহূর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো আমাদের পক্ষে সহজ নয়। তেমনি রোগীদেরও হাসপাতালে আসা সহজ নয়। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইনডোরে, জরুরি বিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০জন রোগী আসে। আর বর্হিবিভাগে ১০০ জনের বেশি রোগী তো থাকেই। মাঝে মাঝে এই সংখ্যা ২০০ জনের বেশি থাকে। এখানে এক্সরে মেশিন নেই। আল্ট্রাসনোগ্রাফ হয় না। প্যাথলজির প্রাথমিক পরিক্ষা নিরীক্ষা কিছুদিন আগ পর্যন্ত হতো না, বর্তমানে হচ্ছে। আগের চেয়ে চিকিৎসা সেবা ভালো হলেও এখনও অনেক সমস্যা আছে।’

খুলনা সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ বলেন, ‘প্রান্তিক জনপদের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে এখনও অনেক সমস্যা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বড় বাধা। এখনও অনেক স্থানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পদগুলো ঠিক মতো পূরণ করতে পারিনি। অনেক স্থানে অবকাঠামোগত সমস্যা আছে। তবে সংকট উত্তরণে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়