ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উপকূলের পরিকল্পনায় থাকতে হবে মানুষের কণ্ঠ  

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৩, ২৯ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৮:৪৪, ২৯ মার্চ ২০২১
উপকূলের পরিকল্পনায় থাকতে হবে মানুষের কণ্ঠ  

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো সমাধানে বড় বড় অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়, কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের দাবি কিংবা মতামত স্থান পায় না। প্রতিফলিত হয় না তাদের কণ্ঠ। পরিকল্পনাগুলোতে মাঠের ছবিটাই যেন অনুপস্থিত থাকে। সে কারণে পরিকল্পনা টেকসই হয় না বলে অনেকে মনে করেন। উপকূলবাসীর দাবি- পরিকল্পনা হতে হবে মানুষ-কেন্দ্রিক। তবেই প্রকল্প থেকে মানুষ উপকৃত হবে।

উপকূলের পানি সংকট নিরসনে স্থানীয় বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেছেন, নিরাপদ পানি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে এলাকা-উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বৃহৎ গবেষণা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তারা বলেন, ভেঙে যাওয়া বাঁধ উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে, স্লুইজ গেট স্থাপন ও টেকসইভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। পুকুরসহ সুপেয় পানির উৎসগুলো পুনঃখননের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। বৃষ্টির পানির যথাযথ সংরক্ষণের উপরও জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের পানি সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছে স্থানীয় নাগরিক সমন্বয়ে গঠিত পানি কমিটি। এ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ সফিকুল ইসলাম বলেন, পানি সংকট নিরসনে বাস্তসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের নীতিগুলোতে এই বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

দুর্যোগের প্রথম শিকার এই নারীরা। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার আম্পান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ছবি

পানি কমিটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে আছে, ১) জাতীয় পানি নীতিমালা ও জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় খাবার পানিতে লবণাক্ততার বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা; ২) জাতীয় নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতিমালায় লবণাক্ততার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা; ৩) জাতীয় নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতিমালা অনুযায়ী লবণাক্ত আক্রান্ত প্রত্যেক গ্রামে কমপক্ষে একটি সরকারি পুকুর খনন করতে হবে; ৪) দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বিরাজমান সুপেয় পানির সংকট নিরসন করে সকলের জন্য লবণমুক্ত সুপেয় পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে; ৫) মিষ্টি পানির উৎস্য যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে চিংড়ি ও অন্যান্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; ৬) কৃষি ও গৃহস্থালী কাজের জন্য মিষ্টি পানির প্রবাহ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে; ৭) ভরাট হয়ে যাওয়া নদী-পুকুর খনন করতে হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘ভূগর্ভের পানির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পুনর্ভরণের (রি-চার্জ) সমস্যা। যে পরিমাণ ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে সেই পরিমাণ পানি আবার ভূগর্ভে যাচ্ছে না। সুপেয় পানির সংকট সমাধানে ভরাট হওয়া সরকারি পুকুর ও খাল-নদী সংস্কার করতে হবে। পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামাঞ্চল-ভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’

 প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। এখন বহুমূখী পেশায় জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন

ক্লাইমেট চেঞ্জ এক্সপার্ট ড. আতিক রহমান বলেন, ‘আমরা যদি বিজ্ঞান-ভিত্তিক তথ্য বুঝতে না পারি, তাহলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনটা বুঝবো না। জলবায়ু পরিবর্তন না বুঝলে পলিসিগুলো সঠিকভাবে করতে পারবো না।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোস্টাল লাইভলিহুড এন্ড এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন)-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো আমাদের এখানে কাজ করছে না। কেননা, এখানে জনবল এবং যন্ত্রপাতি যেভাবে থাকা দরকার, সেভাবে নেই। ফলে অভিজ্ঞ কিংবা দক্ষ কোনো চিকিৎসক কাজ করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা- এই জেলাগুলোতে যে পরিমাণ খাদ্য দরকার, তার তূলনায় খাদ্য অনেক কম উৎপন্ন হয়। সেটি মোকাবিলার জন্যই কৃষি জমিকে লবণাক্ত জল এবং জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্য দুটো বড় কাজ হলো- বেড়িবাঁধ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি সম্প্রসারণ করা। সেজন্য অতিরিক্তি লোকবল, বাজেট এগুলো লাগবে। এটা করা সম্ভব না হলে এ এলাকার খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা কিংবা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে যে, এই অঞ্চলে একটা স্ট্যাটেজিক্যাল এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট করা হবে। এটার মধ্যে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পুরোটাই নিতে হবে। সেটাকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। হলিষ্টিক অ্যাপ্রোচে দেখে সেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পানি সংকট নিরসন করতে পারলে এই এলাকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কমবে।’

বেড়িবাঁধের উপরে ঘর। এখানেও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন

দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনোলজির কনসালট্যান্ট ডা. সন্তোষ কুমার মজুমদার বলেন, পানি সংকট অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে নারীদেরকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে। খাবার পানিই তাদের এই ঝুঁকি কমাতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের এই কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষেরাও। যেমনটা আমিনুর গাজী বলছিলেন, আমরা ত্রাণ চাই না, একটা শক্ত বেড়িবাঁধ চাই। এখানে বেড়িবাঁধ হয়েছে; কিন্তু কংক্রিটের ব্লক দেওয়া হয়নি। ফলে নদীর ভাঙনের ভয় থেকেই গেছে। সুতারখালী গ্রামের রোকেয়া বেগম বাড়ির কাছে খাবার পানির ব্যবস্থা চান। কেউবা রাস্তা চান, কেউবা আবাসন চান। এই ছোট ছোট দাবিগুলো সমন্বয় করার দাবি এলাবাকাসীর। উন্নয়নের সমন্বিত একটা রূপ চান তার।    

দুর্যোগের প্রভাবে নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে খুলনা শহরে চলে গেছেন ফারুক হোসেন সরদার। দুর্যোগের কারণে স্থানচ্যুত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। দুর্যোগে এদের জীবন জীবিকার লড়াই আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এরা সকলেই ফিরতে চান এলাকায়, নিজের বাড়িতে। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা।

 

পড়ুন প্রথম কিস্তি: উপকূলে সুপেয় পানির সংকট

পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি: কৃতিক দুর্যোগে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি 

পড়ুন তৃতীয় কিস্তি: ‘ক্ষুধার্ত নদী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে’

পড়ুন চতুর্থ কিস্তি: ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ছে জীবনের বোঝা 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়