ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

পরিবারের অগোচরে বিয়ে, স্ত্রীকে বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে খুন হন সোহান

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩  
পরিবারের অগোচরে বিয়ে, স্ত্রীকে বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে খুন হন সোহান

আব্দুল্লা আল সোহান

দশ বছরের প্রেমের সম্পর্ক। দুই পরিবারের অগোচরে বিয়ে করেন তারা। আব্দুল্লা আল সোহান (২৬) রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বোনের বাসায় থাকতেন। মাসুমা সিদ্দিকা দোলা থাকতেন গোলাপবাগের ডাক্তার মোল্লা গলিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাসায় কেউ না থাকলে মাঝে মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় যেতেন সোহান।

গত ২৮ মার্চ স্ত্রীকে নিয়ে ইফতার করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যান সোহান। ইফতার সেরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দোলার বাসায় আসেন তারা। সেদিনও বাসায় কেউ ছিলেন না। তখন বাড়িওয়ালার নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক সেই বাসায় আসেন। সোহান ও দোলা স্বামী-স্ত্রী কি না, তার প্রমাণ হিসেবে কাবিননামা দেখতে চান তারা। সোহানের পরিবারের দাবি, কাবিননামা দেখালেও তারা সোহানকে বেধড়ক মারধর করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সোহান। 

সোহানের বাবা মো. ইউনুস খান বলেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে ছিল ব্ল্যাকমেইল করে টাকা-পয়সা নেওয়া। যত টাকা লাগত, দিতাম; ছেলেটাকে কেন খুন করলো?

সোহান হতার পরদিন তার বাবা যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এখন পর্যন্ত পুলিশ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, ওই দিন পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হকের আদালত আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন। 

মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুকিত হাসান বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এজাহারভুক্ত সব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চার্জশিট প্রস্তুতের কাজ চলছে।

সোহান হত্যার কারণ জানতে চাইলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন এসআই মুকিত হাসান। এর পর যোগাযোগ করা হয় যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজহারুল ইসলামের সঙ্গে। 

আজহারুল ইসলাম বলেন, সোহান ও দোলা গোপনে বিয়ে করেন। দুই পরিবারের কেউই জানতেন না বিয়ের বিষয়টি। মেয়ের বাসায় যখন কেউ থাকতেন না, তখন ছেলেটি দেখা করতে আসতেন। বিষয়টি এলাকার লোকজন কয়েক দিন দেখেন। একদিন বাড়িওয়ালাকে নিয়ে তারা বাসায় হাজির হন। সেদিনও দোলার পরিবারের অন্য সদস্যদের কেউ বাসায় ছিলেন না। সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে সোহান ও দোলা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। কাবিননামাও দেখান। কিন্তু, বিষয়টি তারা আমলে নেননি। ছেলেটিকে তারা মারধর করেন। সোহান হার্টের রোগী ছিলেন। যেভাবে মেরেছে, তাতে মারা যাওয়ার কথা না। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। মামলার তদন্ত চলছে। দোষীদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব আদালতে চার্জশিট জমা দেবো।

সোহানের বাবা বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে মাস্টার্স করেছে। পিএইচডি করতে কানাডায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু, কী কারণে আমার ছেলেটাকে খুন করলো, জানি না। ছেলেটা তো শেষ হয়ে গেলো।

তিনি বলেন, সোহান খিলগাঁওয়ে বোনের বাসায় থাকত। মেয়েটার সাথে আগে থেকেই সম্পর্ক। দুই বছর আগে বিয়ে করেছে ওরা। স্ত্রীকে বাসায় এগিয়ে দিতে ওই দিন সে বাসায় যায়। তখন বাসায় কেউ ছিল না। বাড়িওয়ালাসহ কয়েকজন ওদের বাসায় যায়। তাদের সম্পর্ক জানতে চায়। সোহান ও দোলা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দেয়। কাবিননামাও দেখায়। তারপরও সন্দেহের বশে আমার ছেলেটাকে খুন করে। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল—ব্ল্যাকমেইল করে টাকা-পয়সা নেওয়া। যত টাকা চাইতো, দিতাম। তবুও আমার ছেলেটা তো বেঁচে থাকত। ছেলেটাকে কেন খুন করলো তারা? সন্তানকে তো হারিয়ে ফেললাম।

ইউনুস খান বলেন, ছেলেটা কোনো ঝামেলায় যেত না। আমার সেই নিরীহ ছেলেটাকে ওরা খুন করলো। ছেলে তো নেই। প্রকৃত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।

সোহানের ভগ্নিপতি অভি বলেন, একমাত্র ছেলে সোহানকে হারিয়ে পরিবারটা নিঃস্ব হয়ে গেছে। পরিবারটিতে এখন সুখ নাই। মা মৃতপ্রায়। একমাত্র ছেলেকে হারালে বাবা-মা কি ভালো থাকতে পারে? হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ সাজা চাই আমরা।

সোহানের বাবার করা মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ বিকেলে সোহান তার স্ত্রীকে নিয়ে টিএসসিতে যান ইফতার করতে। ইফতার শেষে স্ত্রীকে পৌঁছে দিতে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে বাসায় যান। রাত ৮টার দিকে বাড়িওয়ালা শেখ জামাল এসে সোহানকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। সোহান স্ত্রীকে বাসায় একা রেখে বের হতে না চাইলে শেখ জামালের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত অন্যরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে মারতে মারতে নিচে নিয়ে যান। বাসার নিচে এনে আসামিরা তাকে এলোপাথারি মারধর করে গুরুতর জখম করেন। সোহান প্রাণ বাঁচাতে পাশেই মনোয়ারা হাসপাতালের বাথরুমে ঢুকে ভগ্নিপতি অভিকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান। অভি এসে সোহানকে উদ্ধার করেন। মনোয়ারা হাসপাতালে জরুরি বিভাগ না থাকায় আল-ফালাহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় তাকে। সোহানের অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশ এ মামলায় শেখ মো. জামাল, সোহেল মিয়া, সাজিদ হোসেন, গাজী হাসমুন আলভী, শামীম শেখ, সাগর, নাইম ও কাউছার আহমেদ দিপুকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে প্রথম চারজন জামিনে আছেন। শামীম কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ও অপর তিনজন কারাগারে আছেন। 

আসামি সাজিদের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান খোকা বলেন, এজাহারে সাজিদের নাম ছিল না। এক আসামির স্বীকারোক্তিতে তার নাম আসে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এটিম বুথে নিয়ে সোহানকে ভয় দেখানো। মামলার তদন্ত চলছে। আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট আসলে আইনি লড়াই করে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করব।

উল্লেখ্য, সোহান পটুয়াখালীর বাউফল পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও চন্দ্রপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ইউনুস খানের ছেলে।

মামুন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়