ঢাকা     সোমবার   ২০ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

বিশ্বকাপ স্বপ্নে ঘুণপোকার গেরস্থি?

নোমান মোহাম্মদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৭ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ১০:৩১, ৭ অক্টোবর ২০২৩
বিশ্বকাপ স্বপ্নে ঘুণপোকার গেরস্থি?

বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপ কি সেই প্রেমিকার মতো, যাঁকে শুধু দূর থেকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু কখনো আপন করে পাওয়া যায় না?

এবারও তাই হতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্নে টুর্নামেন্টের আবহে যে ঘুনপোকার গেরস্থি, তাতে সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেবেন কিভাবে!

অথচ এই আসরটি কত অন্য রকমই না হতে পারত! শেষ পর্যন্ত ট্রফির সঙ্গে অভিমানী দূরত্বটা না হয় থাকত! কিন্তু বিশ্বকাপের আগে স্বপ্নের আকাশটা তো সূর্যস্পর্শের স্পর্ধার হতে পারত! হতেই তো পারত, নাকি?

বিশ্বকাপে ১০ দলের মধ্যে নাম লেখানোটাই এখন এক চ্যালেঞ্জ। কতটা? প্রথম দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সে ব্যর্থতাতেই তা স্পষ্ট। দীর্ঘ, স্নায়ুক্ষয়ী, জটিল বাছাইপর্ব পেরোনোর শর্তপূরণ করতে পারেনি বলে। বাংলাদেশ সে শর্ত কেবল পূরণ করেনি; বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব শেষ করেছে তিন নম্বরে থেকে। গত বছর দুয়েকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কার মতো দলকে। 

উত্তঙ্গু আত্মবিশ্বাসে টগবগিয়ে ফোটা দলটি বিশ্বকাপ আসতে আসতে তাই এমন চুপসে যাবে কেন!

দোষটা যাঁরই হোক, দায়টা বাংলাদেশের ক্রিকেট সিস্টেমের। সাধের যে সৌধ গড়ে উঠেছিল একটু একটু করে, সেটিকে আয়নাঘর বানিয়ে ঢিল ছুঁড়েছি নিজেরাই। নকশির মিহি বুননে তৈরী ক্যানভাসে মাকু চলছে এখন দিকভ্রান্তের মতো। উদভ্রান্তের মতো।

বিশ্বকাপের বছরে কোচ পরিবর্তন দিয়ে যার শুরু। হ্যাঁ, চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আগেও বাংলাদেশের কোচ ছিলেন। তাঁর অধীনে বলার মতো সাফল্যও ছিল কিছু। কিন্তু তাঁর সাফল্যেও রেসিপিটা আলাদা। এজন্য চড়া মূল্যও এক অর্থে অবধারিত। সেটি ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনে। কিংবা নিজের মতামত চাপিয়ে দেবার গোয়ার্তুমিতে। অথবা পছন্দ-অপছন্দের তীব্র প্রকাশে। আগের দফায় এর সাক্ষী বাংলাদেশ ক্রিকেট। 

হাথুরুসিংহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত যে ক্রিকেট বোর্ড, তাঁরা তো সাক্ষীগোপালের ভূমিকায়। ফলে জাতীয় দলের ড্রেসিংরুম হয়ে ওঠে এক অসুখী জনপদ।

বিশ্বকাপের মাস দুয়েক আগে অধিনায়ক পরিবর্তনে আরেক ধাক্কা। তাতেও কোচের প্রত্যক্ষ প্রভাব স্পষ্ট। তামিম ইকবালের নেতৃত্বে ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশ কাটাচ্ছিল সোনালী সময়। হাথুরুর সঙ্গে মনোমালিন্যেই মূলত দায়িত্বটা ছেড়ে দেন তিনি। নতুন অধিনায়ক করা হয় সাকিব আল হাসানকে।

নতুন কোচ, নতুন অধিনায়ক। তাঁদের নতুন ধ্যানধারণা থাকাটাই স্বাভাবিক। অদল-বদল, পরীক্ষা-নিরীক্ষাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এত দ্রুত এত এত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারল কই দল! ফলে বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে একের পর এক বিপর্যয়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ। এশিয়া কাপ। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ। 

প্রত্যাশার উঁচু রাগের তারটা তাই ছিঁড়ে যাবার দশা যেন!

ঠিক দুই যুগ আগে, সেই ১৯৯৯ আসর থেকে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের। প্রথম তিন টুর্নামেন্টে এক রকম আশাহীন যাত্রা ছিল। তবুও তো ২০০৭ বিশ্বকাপে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেয় প্রবলভাবে। ভারতকে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিয়ে। আইসিসি র‌্যাংকিংয়ে এক নম্বরে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হতভম্ব করে।

পরের তিন আসরে তাই প্রত্যাশা বেড়েছে। ক্রমাগত। জ্যামিতিক হারে। কিন্তু প্রাপ্তির ভাঁড়াড়ে গর্ব করার মতো তেমন কিছু কই! সেই তো তিনটি করে জয়। এর মধ্যেও ফরম্যাটের কারণে ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলাটাকে দেখা হয় বড় অর্জন হিসেবে। 

২০২৩ বিশ্বকাপেও যদি তাই হয়, তাহলে আর দেশে ক্রিকেট এগুলো কতটা! অথচ ওয়ানডের নতুন অধিনায়ক সাকিব বিশ্বকাপের তিন জয়ের রেকর্ড মনে করিয়ে ইচ্ছেঘুড়ির ভোকাট্টা করেন। কোচ হাথুরু ক্রিকেটপাগল জাতির আশার ফানুসে উপহাস করেন ‘ঘুম থেকে জেগে ওঠার’ তত্ত্বে। নিজ দলের ওপর কোচ-ক্যাপ্টেনের ভরসা না থাকলে সুবর্ণ সময়ের আলিঙ্গন কিভাবে করবে বাংলাদেশ!

তবুও স্বপ্ন দেখে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। তবুও অপার্থিব আশায় বুক বাঁধে এই মানচিত্র। ১০ দলের মধ্যে সেরা চারে থেকে সেমিফাইনাল খেলার অন্তত। কঠিন পথ। দুর্গম পথচলা। বাংলাদেশের চেয়ে কত ভালো প্রস্তুতি অনেক দলের। ধারে ভারে, শক্তিতে সামর্থ্যে এগিয়ে অনেকে।

তা হলেও কি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারানো অসম্ভব? চেন্নাইয়ের চেনা ধাঁচের উইকেটে নিউ জিল্যান্ডও কি অজেয়? এশিয়া কাপে দুবার শ্রীলঙ্কার কাছে হারের  রেকর্ড মনে করাবেন? তাহলে ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ চার ওয়ানডেতে তিন জয়ের পরিসংখ্যানও ভুলে গেলে চলবে না। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে তো এ বছরই ওয়ানডেতে হারিয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে জিতে এসেছে সিরিজ। নেদারল্যান্ডসের পঁচা শামুকে নিশ্চয়ই পা কাটবে না।

কে জানে, এবারের বিশ্বকাপে প্রত্যাশাটা কম বলেই হয়তো প্রত্যাশাতীত কিছু করে ফেলতে পারে বাংলাদেশ। অলৌকিক তো এভাবেই হয়। রূপকথার গল্প তো এভাবেই লেখা হয়।

আর আমাদের জন্য, এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের জন্য, সবুজ এই গ্রহের ২০/২২ কোটি বাঙালির জন্য ক্রিকেটের চেয়ে বড় রূপকথা আর কী আছে, বলুন!

লেখক: সম্পাদক, নট আউট নোমান ও অলআউট স্পোর্টস

ঢাকা/বিজয়

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়