ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

দরিদ্রের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন আওয়ামী নেতা শাহ আলম

নিজামুল হক বিপুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ১২ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০
দরিদ্রের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন আওয়ামী নেতা শাহ আলম

দরিদ্রের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের এক নেতা। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, বিত্তশালী হলেও তিনি নিজেকে নামিয়ে এনেছেন ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিকশাচালক, নিম্নবিত্তদের কাতারে। মো. শাহ আলম নামের এই নেতা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালকও বটে। তার পরিচয় এখানেই শেষ নয়। তিনি ওএমএস-এর ডিলার। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জেলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক। শহরের ‘হ্যালো সুইটি মিট’-এর মালিক এবং জেলা রেস্তোরাঁ সমিতির সভাপতিও এই হতদরিদ্র ব্যক্তি!

তিনি নিজে নন, পরিবার এমনকি শ্যালক-শ্যালীকার পরিবারের ১৩ সদস্যকেও তিনি একই কাতারে নামিয়ে এনেছেন। এরা সবাই দরিদ্র! এর মধ্যে তার এক ভাই প্রবাসী! এরা এতোটাই দরিদ্র যে এই সংকটকালে খাবার পাচ্ছেন না! যে কারণে দরিদ্র মানুষের জন্য যে ১০ টাকা কেজি দরে ওএমএস কার্ডের চাল দিচ্ছে সরকার, সেই তালিকায় শাহ আলমের পরিবারের ১৩ সদস্যকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কাজটি করেছেন ব্রাহ্মণবাড়ীয় পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ইতোমধ্যে তারা প্রথম ধাপে চাল উত্তোলনও করেছে। বিষয়টি যখন জানাজানি হয়, তখন অনেকে লজ্জা পেলেও, শাহ আলমের কাছে এটি কোনো লজ্জাজনক ঘটনাই মনে হয়নি। যদিও দলীয় লোকজনের কাছে বিষয়টি বিব্রতকর বিধায় পরে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শাহ আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

করোনা মহামারি আমাদের কতো কিছু দেখাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। অবরুদ্ধ অবস্থা অঘোষিতভাবে কিছুটা শিথিল হওয়ায় দিনমজুররা খাবারের জন্য ঘর থেকে বের হচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই এখন পর্যন্ত নিজেদের আগলে রেখেছেন ঘরের মধ্যে। এই দেড় মাস সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে। এ জন্য দলীয় নেতাদের উপর ভরসা না করে ৬৪টি জন সচিবকে প্রতিটি জেলায় মনিটরিং-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুই-ই আছে। সরকারি ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।

দুর্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন জেলা পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। তার নির্দেশনাতেই খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তর ১০ টাকা কেজি দরে বিশেষ ওএমএস কার্যক্রম শুরু করে ৪ এপ্রিল। কিন্তু এই কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে কিছুটা বিশৃঙ্খলা এবং সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছিল দেখে সেটি বন্ধ করে বিকল্প পদ্ধতি চালু করা হয়। দিনমজুর, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, শ্রমিক, রিকশাচালক, সমাজের অসহায় দুস্থদের তালিকা করে প্রতি সপ্তাহে পরিবার প্রতি ১০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি চাল দেওয়ার জন্য ওএমএস কার্ড বিতরণ করা হয়। যারা ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ডসহ বিভিন্ন রকম সরকারি সহায়তা পাচ্ছে তাদের এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থাকা এবং করোনার কারণে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষরাই এই তালিকায় অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু সরকারের এই নির্দেশনা যে যথাযথভাবে অনুসরণ হয়নি বা হচ্ছে না তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া গেছে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। তাও গ্রাম পর্যায়ে নয় একেবারে পৌরসভায়। প্রকাশিত সংবাদ থেকে যতটুকু জানা গেছে তা এই লেখার শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলমের পরিবারের ১৩ সদস্য ছাড়াও আরও অন্তত ৭৮ জনের নাম আছে এই তালিকায়। যারা অবস্থাসম্পন্ন। যদিও পরে এদের সবার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তালিকা থেকে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে তাদের তালিকাভূক্ত করা হলো? কারা করলো? কিসের স্বার্থে? এই প্রশ্নগুলোর জবাব দ্রুত খুঁজে বের করা দরকার। একই সঙ্গে দেশের অন্য কোন জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এমন আর কোনো ব্যক্তি ওএমএস-এর তালিকাভূক্ত হয়ে কার্ড নিয়েছেন কিনা সেটাও খুঁজে বের করা উচিত। পাশাপাশি সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরালো করা প্রয়োজন। কারণ এই মহামারির সময়ে সরকার যেখানে অসহায় হতদরিদ্র মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর, সেখানে সরকারি দলের কোনো নেতা নিজের দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে দরিদ্র মানুষের গ্রাস কেড়ে নেবেন তা হতে পারে না।

আরেকটি বিষয় ছোট করে উল্লেখ করে এই লেখার ইতি টানবো। সরকার ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের (প্রতি পরিবারে চারজন) দুই কোটি মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দেবে। তালিকাও প্রায় প্রস্তুত। আমার নিবেদন থাকবে, এই তালিকাটি যেন নির্ভুল হয়। প্রকৃত দরিদ্র ও সংকটাপন্ন মানুষই যেন এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হন। যেহেতু এখানে নগদ টাকার বিষয় জড়িত, তাই অনেকেই রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে নিজের নাম অন্তর্ভুক্তক করার চেষ্টা করবে বা করতে পারে। এই তালিকা নিয়ে যেন কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে, বিতর্কের সৃষ্টি না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘মানুষ না খেয়ে থাকবে না’- বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখছেন, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এগুচ্ছেন, তা সফল করতে হলে অধিকতর যাচাইবাছাই, সতর্কতা এবং মনিটরিং-এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়