ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

গৌর গোপালের বগুড়ার দই

একে আজাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ১৩ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গৌর গোপালের বগুড়ার দই

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই

একে আজাদ, বগুড়া : স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। মাটির ছোট-বড় হাড়িতে সুস্বাদু এই দই তৈরি হচ্ছে বগুড়ার জেলা শহরসহ গ্রামাঞ্চলে। লাখো শ্রমিকের কর্মযজ্ঞে প্রতিদিন কোটি টাকার দই বিক্রি করছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। সারা বছরই দইয়ের চাহিদা থাকায় দিন দিন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অনেক কর্মহীন মানুষ।

 

দইয়ের শুরুটা: হিন্দু সম্প্রদায়ের মতে, রাধা-কৃষ্ণ জন্মের পর তারা দুধ থেকে তৈরিকৃত এক ধরনের খাবার খেত যাকে ওই সময় দধি বলা হত। এই দধি থেকেই কালক্রমে দই নামকরণ হয়ে আসে। তবে বগুড়ার স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে, দইয়ের শুরুটা হয়েছিল নবাব আমলে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারের কাছে এ দই নবাবি খাবার হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিল।

 

তৎকালীন বগুড়ার নবাব মোহাম্মাদ আলীর কাছে আসা ইংল্যান্ড ও বন্ধুপ্রতীম অন্যান্য দেশের অতিথিদের তিনি আপ্যায়ন করাতে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ দই পারিবারিক খাদ্য তালিকায় আনেন। নবাববাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের খাবার শেষে দই দেওয়া হত।  নবাবি আমল থেকে দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ির দই।

 

আর এই দই তৈরি করতেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গৌর গোপাল পাল নামের এক গোয়ালা। খুব সুস্বাদু হওয়ায় গৌর গোপালের এই দই ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে এই ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে জেলার বিভিন্ন এলাকায়।  প্রথম দিকে শুধু ঘোষবাড়ির লোকজন দই তৈরি করতেন। ঘোষদের ছোট দোকান থাকলেও তখনও ফেরি করেই দই বিক্রি হত। সেসময় মাটির হাঁড়িতে সরার দই তৈরি করেন। এখন তা কালক্রমে ছেট-বড় মাটির সরা ও প্লাস্টিকের পাত্রে ওই দই বিক্রি হচ্ছে।  

 



স্বাধীনতার পর বগুড়ায় দই তৈরিতে নতুনত্ব নিয়ে আসে দুটি মুসলিম পরিবার। তারা হলেন বগুড়া শহরের মহরম আলী ও বাঘোপাড়ার রফাত আলী।  ’৯০ এর দশকের শুরুর দিকে প্যাকেজিং ও দই সংরক্ষণেও আনেন নতুনত্ব¡। ওই সময় থেকে মনোরম ও সুসজ্জিত শোরুম করে দই বিক্রির প্রচলন শুরু হয়।

 

দই তৈরির প্রক্রিয়া: স্থানীয় দই কারিগরদের তথ্যমতে, দই তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে গাভীর খাঁটি দুধ এবং চিনি ব্যবহার করা হয়। একমণ দুধ থকে ২৫ কেজি দই উৎপাদন হয়। দুধ ও চিনি এক টিনের ড্রামে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রচ- তাপমাত্রায় তেঁতুলের খড়ি দিয়ে সিদ্ধ করতে হয়। পরে সিদ্ধ করা দুধ মাটির হাঁড়িতে ভরে বাঁশের তৈরি ছাতা আকৃতি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। আর ওই ছাতার ঢাকনার মাঝখানে তেঁতুল খড়ির কয়লাও দিতে হয়। এভাবে ৮ ঘণ্টা ঢেকে রাখার পর তা জমে সুস্বাদু দইয়ে পরিণত হয়।

 

দইয়ের বাজার: বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া, এশিয়া সুইটমিট ও দইঘর, চেলোপাড়ার কুরানু, নবাববাড়ির রুচিতা, বিআরটিসি মার্কেটের দইবাজার, মিষ্টিমহল, সাতমাথার চিনিপাতাসহ শতাধিক শোরুমে পসরা সাজিয়ে দই বিক্রি হচ্ছে। আবার শহরের বাইরে বাঘোপাড়ার রফাত, শেরপুরের রিপন দধি ভা-ার, সৌদিয়া, জলযোগ, বৈকালি ও শুভ দধি ভা-ার থেকে প্রতিদিন প্রচুর দই বিক্রি হয়।

 

বিয়েসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের আপ্যায়নে দইয়ের প্রচলন রয়েছে।  বগুড়ার দই মিষ্টির দোকান এশিয়া কর্তৃপক্ষ জানায়, ওজন দিয়ে তাদের দই বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় প্রতি পিস হিসেবে। এখন তাদের স্পেশাল সরার দাম ১৮০ টাকা, সাধারণ ১১০/৩০ টাকা ও সাদা দই ১২০ টাকা হিসেবে বিক্রি হয়। এখানে দইয়ের চাহিদা প্রচুর। বেলা ৩ টার মধ্যে দই শেষ হয়ে যায়।

 

এ ছাড়া বাজারে কিছু কম দামে আরো বিভিন্ন ব্রান্ডের দই পাওয়া যায়। যার প্রতি পাতিল বিক্রি হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।

 



রপ্তানিতে দই: প্রায় ৫ বছর আগে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বগুড়ায় তৈরি দই প্রথম যায় বাণিজ্যিকভাবে। এ মেলায় অন্যতম আকর্ষণ ছিল বগুড়ার দই।

 

শোভা এন্টারপ্রাইজের  সিইও সৈয়দ আহম্মদ কিরণ জানান, বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে দইয়ের রপ্তানি হচ্ছে না। রপ্তানি পণ্য তালিকায় দই অন্তর্ভুক্তি নেই। আর বন্দরে দ্রুত এ খাদ্যপণ্য খালাসের ব্যবস্থাও নেই। যদি এতে সরকার অন্তরিক হয় তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাজার পাবে বগুড়ার দই।

 

এ ছাড়ও উত্তরাঞ্চলে কোনো বিদেশি অতিথি বেড়াতে এলে তারা ফেরার সময় দই কিনে নিয়ে যান। হাতে হাতে এই দই পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে রপ্তানি করছেন ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়া, কাতার, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে বাংলাদেশি আছে।

 

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি দই তৈরির গুণগতমান  ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি মনিটরিংয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতার। তাহলে শিল্পের রপ্তানিতে শীর্ষে থাকবে এই দই।

 

 

 

রাইজিংবিডি/বগুড়া/১৩ এপ্রিল ২০১৬/একে আজাদ/রিশিত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়