ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পড়তে যার বারণ ছিল, বিশ্বজয়ী সেই খুকির গল্প

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পড়তে যার বারণ ছিল, বিশ্বজয়ী সেই খুকির গল্প

হাসান মাহামুদ : সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্ম ছোট্ট খুকির। বাবা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলা। তাও কী না একটি দেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। মা দেশের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্যদের একজন। জন্মের পর থেকেই সে খুকিকে ডাক্তার আর হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। কারণ, খুকি ঠিক মতো তাকায় না, মুখে শব্দ করে না।

একে একে ২৪ মাস পর হয় খুকি কথা বলে না। আরো দুই মেয়ে, এক ছেলে থাকলেও খুকিকে আদরের কমতি রাখেনি বাবা-মা। এর মধ্যে আবিস্কার হলো, খুকির চোখে সমস্যা। ডাক্তার পরামর্শ দিল- খুকিকে পড়তে দেওয়া যাবে না। বইয়ের অক্ষর খুঁজতে গেলেই বাঁধবে বিপত্তি। চিরতরে চোখের আলোই নিভে যেতে পারে খুকির।

হঠাৎএকদিন খুকি বলে বসলো- ‘I want barley water’ (আমি বার্লি পানি চাই)। ‘বাবা’ কিংবা ‘মা’ বলে ডাক নয়, সোজা নিজের চাহিদার কথা দিয়েই মুখের বুলি ফুটলো খুকির। বাবা-মায়ের তো খুশির শেষ নেই। নাইবা ডাকলো কাউকে, খুকি তো অন্তত কথা বললো!

একে একে কেটে গেল আরো দু’বছর। খুকি এবার বায়না ধরে স্কুলে যাবার। সমাজ রক্ষায়ও তো মেয়েকে স্কুলে দিতে হবে। শেষে বুকে পাথর বেঁধেই বাবা-মা শর্ত জুড়ে দিল, ‘স্কুলে যেতে পারবা, কিন্তু পড়া যাবে না’। খুকি খুশি মনে স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। শিক্ষকদের অনুরোধ করা হলো, খুকিকে যেন শুধু সময় কাটানোর জন্য স্কুলে আসার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকরাও মেনে নিল খুকির দৃষ্টিশক্তি হারানোর শঙ্কায়।

মাত্র চার বছর বয়সে নিজে নিজেই পড়তে শিখে গেল খুকি। ‘Gutta Perchas Adventures Under The Sea’ পড়তে পেরে দৌড়ে গেল বাবা-মা’র কাছে- ‘আমি পড়তে পারি’। বাবা-মা খুশী হওয়ার চেয়ে বেশি হলো চিন্তিত। কারণ, খুকির যে চোখে সমস্যা। পড়াশুনা করলে যদি পরে চোখই চলে যায়!

খুকিকে পেয়ে বসলো পড়ার নেশা। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে গিয়ে বাবা-মার হাতে কত যে ধরা পড়লো। শাসনের বদলে বাবা-মা আদর করে বুঝিয়ে বলে, ‘বেশি পড়ো না মা’। কিন্তু খুকি তো শুধু পড়া না, এবার লেখাই শুরু করে দিল। মাত্র আট বছর বয়সে কলকাতার শিশু ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক শংকর’- এ ছাপা হয়ে গেল খুকির লেখা গল্প। এটি তখন সম্ভবত এই উপমহাদেশের সবচেয়ে কম বয়সী কারো গল্প। এরপর নিয়মিত লেখা ছাপা হতে লাগলো উর্দু ম্যাগাজিন ‘বানাট’-এ।

সেই খুকি বড় হয়ে হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। হলেন, একটি দেশের মানবাধিকার আন্দোলনে পথিকৃৎ। প্রতিষ্ঠা করলেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার সংগঠন। অর্জন করলেন আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড।

সেই ছোট্ট খুকির নাম ‘সালমা রাশেদা আক্তার বানু’। ‘সালমা সোবহান’ নামে তিনি পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সালমা সোবহান একাধারে শিক্ষক, আইনবিদ, গবেষক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, সর্বোপরি একজন মানবহিতৈষী।

আজ তার ৮০তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩৭ সালের আজকের দিনে (১১ আগস্ট) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মো. ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। পরবর্তী সময়ে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যে দায়িত্ব পালন করেন। মা শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্যদের অন্যতম। এছাড়া শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ মরোক্কোয় পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ মা-বাবা দু’জনই ছিলেন রাষ্ট্রদূত। শুধু তাই নয়, সালমা সোবহানের শ্বশুরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরকম নজির ইতিহাসে বিরল।

সালমা সোবহানের স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সালমা সোবহানের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল অতুলনীয়। উপমহাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তার মামা। চাচা বিচারপতি হেদায়েত উল্লাহ ছিলেন ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি।

এতো উজ্জল পারিবারিক ঐতিহ্য, এতো সম্ভ্রান্ত মানুষের আত্মীয় পরিচয় ছাপিয়ে সালমা সোবহান আপন মহিমায় হয়ে উঠেছেন অতুলনীয়।

১৯৫৮ সালে কেমব্রিজের গির্টন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টার সদন লাভ করেন। সালমা সোবহান তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা ব্যারিস্টার এবং বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ১৯ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। আইন বিভাগের একেবারে শুরুতে যেসব আইনবিদ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সালমা সোবহান তাদের অন্যতম। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের (বিলিয়া) গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷

দেশের বিভিন্ন জেলার জজদের জন্য সংগঠনটি আইন বিষয়ে যে জুডিশিয়াল প্রশিক্ষণের আয়োজন করে, তাতে সালমা সোবহান ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স পার্সনাল। সালমা সোবহানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং ধারণা নিয়েই প্রথম এধরনের প্রশিক্ষণের পাঠক্রম তৈরি করা হয়।

সালমা সোবহান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং মহিলা পরিষদের প্রথম নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির অত্যন্ত সক্রিয় একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ‘ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড’ তৈরির কাজে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন। সালমা সোবহান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং আমৃত্যু উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত তিনি কোর্ট ল’ রিপোর্টসের সম্পাদক ছিলেন। সালমা সোবহান ১৯৮৫ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে যোগদান করেন। তিনি ব্র্যাকের পরিচালনা পরিষদ সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নারীমুক্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয় তার অবদানকে। চিন্তা-চেতনায় ছিলেন অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এবং অনুসরণযোগ্য একজন মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সালমা সোবহান এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন কাজ করে গেছেন, তেমনি মানবাধিকারের আন্দোলনেও রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বাংলাদেশে প্রথম নারী হিসেবে তিনি ফতোয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন।  মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে তিনিই প্রথম আওয়াজ তুলে গেছেন বাংলাদেশে।

১৯৮৬ সালে তিনি এবং আরো আটজন মানবাধিকার কর্মী মিলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। তার কর্মকালে মানবাধিকার এবং বঞ্চিত নারীদের আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে আসক বাংলাদেশের একটি প্রধান সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে আসক-এর কর্মী সংখ্যা দুইশ এবং এটি এখন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি সংস্থা। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে প্রতিদিন সহযোগিতা চাইতে আসা বা মক্কেলদের অনেকের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এই রেওয়াজটি সালমা সোবহানই চালু করে গেছেন।

আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) প্রতিষ্ঠায়ও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এছাড়া অনেক মানবাধিকার ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট সুলতানা কামাল একবার সালমা সোবহান সর্ম্পকে বলেছিলেন, ‘তারা জন্মান বলেই আমাদের সামনে এমন একটা দরজা খুলে যায়; যার ভেতর দিয়ে আমরা নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাই, যেখানে মানুষ মর্যাদা অধিকার নিয়ে বাস করতে পারে’

এমন গুণীরা শতাব্দীতে হাতে গোনা জন্মায়। সালমা সোবহান তেমনি বিরল মানবিক গুণসম্পন্ন, অনুসরণযোগ্য একজন মানুষ। বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা অটুট থাকুক, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উত্তরোত্তর উন্নতি হোক- তার জন্মবার্ষিকীতে এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ আগস্ট ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ