ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ওরা স্কুলে যেতে চায়

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২১, ৩ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওরা স্কুলে যেতে চায়

আমিনুর রহমান হৃদয় : ‘স্কুলে পড়া লাগবে না। এখন থেকে সার্কাসে খেলা দেখিয়ে টাকা আয় করতে হবে। আমাদের মতো গরীব মানুষের ভাগ্যে লেখাপড়া নাই।’ কথাগুলো ১০ বছর বয়সী দীপকচন্দ্র মজুমদারকে বলেছে তার বাবা-মা।

দ্য গ্রেট রওশন সার্কাসের খুদে শিল্পী দীপকের সঙ্গে সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ওরস মেলায় কথা হয় রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদকের। দীপক জানায়, তার বাবা ও মা দু’জনেই সার্কাসে খেলা দেখায়। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে আর বড় ভাই ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। রংপুরের ডোমার উপজেলায় তাদের বাড়ি।

দীপক আরো জানায়, স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় তাকে বাধ্য করেই তার বাবা-মা সার্কাসে নিয়ে এসেছে। গত ৩ বছর সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছে জানিয়ে দীপক জানায়, আমার এইসব সার্কাস ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয় খেলা দেখাতে। একবার খেলা দেখাতে গিয়ে উপর থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ছিল। প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম। যদিও এখন আর ভয় পাই না। তবুও সার্কাস খেলা দেখাতে আমার ভালো লাগে না। স্কুলে যেতে মন চায়। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে মন চায়।
সার্কাসে খাঁচায় বন্দি পশুর মতো সময় কাটে জানিয়ে সে আরো বলে, ‘লেখাপড়া করার সুযোগ পেলে লেখাপড়া করবো। বাবা-মাকে লেখাপড়ার কথা বলেও কোনো লাভ হয় না। বাবা-মা বলেন, গরীব মানুষের ভাগ্যে লেখাপড়া নাই। সার্কাসে খেলা দেখিয়ে টাকা আয় করাই নাকি আমাদের ভাগ্যে আছে। লেখাপড়া করে আমার পুলিশ হওয়ার ইচ্ছে।’

 


শুধু দীপক নয়, তার সমবয়সী আরো বেশ কয়েকজন শিশু সার্কাসে খেলা দেখায়। পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে মোহাম্মদ জীবন (৭) সার্কাসে যোগ দিয়েছে তার মামার সঙ্গে। মামা-ভাগ্নে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি শারীরিক কসরত দেখায় তারা। জীবন বলে, ‘স্কুলে তো পড়তে মন চায়। কিন্তু ভয়ে কাউকে বলতে পারি না। বাবা-মাকে ছেড়ে মামার সঙ্গে সার্কাসে থাকি। সার্কাসে খেলা দেখাতে এখন ভালোই লাগে।’ তবে দীপকের মতো এই খুদে শিল্পী তার ভবিষ্যত ইচ্ছের কথা বলতে পারেনি।

দীপক ও জীবনের মতো সার্কাসে খেলা দেখায় শিলা (১০) ও পুতুল(১২)। ওরা দুই বোন। ওদের বাবা-মাও এই সার্কাসেই খেলা দেখিয়ে থাকে। পুতুল জানায়, স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে করতো এক সময়। মাকে বলেছিলাম। মা বলেছিল, মেয়েদের লেখাপড়া করে কী হবে? কয়েকদিন পর তো বিয়ে হয়ে যাবে। এরপর আর কখনো স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছের কথা মাকে বলি নাই।’

 


সার্কাসের জীবন খুব কষ্টের জানিয়ে শিলা বলে, ‘আমাদের কোনো বন্ধু নাই। দুই বোন খেলা দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিই। এভাবেই বেঁচে আছি সার্কাসে। এইটা কোনো জীবন না।’

রাইজিংবিডির প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এইসব খুদে সার্কাস শিল্পীদের অভিভাবকদের সঙ্গে। তারা জানালেন, পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণেই নিজেদের ছেলেমেয়েদের সার্কাসে নিয়ে এসেছেন। খেলা দেখিয়ে তাদের ছেলেমেয়েরাও এখন ভালো টাকা আয় করছেন। এতে পরিবারের অভাব কিছুটা হলেও কমছে। প্রত্যেক বাবা-মায়েরই স্বপ্ন থাকে ছেলেমেয়েরা ভালো থাকুক- এই কথা বলছিলেন রূপালী আকতার। তিনি বলেন, ‘নিজেও অভাবের কারণে এই সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। এখন আমার দুই মেয়েকেও সেই একই কারণে সার্কাসে যুক্ত করেছি। মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছে মনে জাগলেও খরচ চালানোর মতো সামর্থ নেই। সার্কাসেই আমাদের জীবন, সার্কাসেই হবে আমাদের মতো গরীবদের মরণ।’

প্রায় একই কথা জানান অভিভাবক মোহাম্মদ কাশেম ও কমল রায়। মোহাম্মদ কাশেম বলেন, ‘সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে সার্কাসের এইসব শিশুদের পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে ভালো হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি তারা সার্কাসে খেলাও দেখাবে।’ তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সার্কাসের প্রত্যেক শিল্পীকে ছোট বয়স থেকেই খেলার কৌশল আয়ত্ব করতে হয়। এইজন্য স্কুলে যেতে পারে না তারা। তাদের অনেকে নিজের নামও লিখতে পারে না। পড়তেও পারে না।

পড়ুন : *

* ‘জোকার’ ওদের নাম
 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জানুয়ারি ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়