ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আলোহীন পৃথিবীতে স্বপ্নই শাহীনের আলো

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২২, ৭ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আলোহীন পৃথিবীতে স্বপ্নই শাহীনের আলো

শাহীন আলম

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘যেদিন সম্পূর্ন অন্ধ হয়ে যাই, সেদিন নিজেকে মনে হয়েছিল স্বপ্নহীন মৃত মানুষ। বেঁচে থেকে বিশেষ কিছু হবে না। জীবনে তো আর দেখতেই পাবো না।’- কথাগুলো বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শাহীন আলম।

 

জন্মের পর চোখ মেলে শাহীনও দেখেছিলেন পৃথিবীর আলো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ঝিনাইদহ মহেশপুর উপজেলার শাহীনের বয়স যখন দুই আড়াই বছর, তখন চোখ দিয়ে অকারণেই পানি পড়ত। দাদা-দাদি নিয়ে যান নিজ গ্রাম আলমপুরের গ্রাম্য কবিরাজের কাছে। কবিরাজের ভুল চিকিৎসায় চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন।

 

আলমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শাহীনের স্কুল জীবন শুরু। গ্রামের অন্য ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে যেতেন। শাহীন বলেন, ‘চোখে কম দেখায়, শিক্ষকেরা অবহেলা করতেন, অন্য ছাত্রদের মতো কেয়ার করতেন না। সব সময় বিমর্ষ থাকতাম। একাকিত্ব বোধ করতাম। পরিবারও সব সময় আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকতো। পরীক্ষায় সবাই লিখতো, আমি বসে থাকতাম। সবার রেজাল্ট আসতো, আমার আসতো না। এভাবে দুই তিন বছর চলতে থাকে।’

 

আট বছর বয়সে পাশের হরিনাথপুর গ্রামের দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ওই মাদ্রাসার শিক্ষকেরা একই আচরণ করতেন। একদিন মাঠে ঘুরতে গেলে, দূর সম্পর্কের এক দুলাভাই চুয়াডাঙ্গা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের তথ্য দেন। সেখানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় ‘সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কার্যক্রম’ পরিচালিত হতো। ওই বিদ্যালয়ে শাহীন ভর্তি হন। ওখানে ব্রেইল পদ্ধতির সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। দশজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্কুলের আবাসিক হলে থাকতেন তিনি। সেই থেকেই পরিবার থেকেই আলাদা থাকতেন। তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষার পর বাড়িতে বেড়াতে গেলে, অসতর্কতায় ডান চোখে বাঁশের কঞ্চির আঘাত লাগে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। বাবার হাতে টাকা না থাকায় সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিতে পারেনি। ডান চোখটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এ সময় চোখের প্রচন্ড ব্যথায় ছয় মাস অসুস্থ ছিলেন শাহীন।

 

পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর পরিবার চাইলেন অনন্ত বাম চোখটা ভালো হোক। চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যান মাগুরা মালেক চক্ষু হাসপাতালে। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন চোখে নতুন লেন্স লাগানোর। চোখের প্রেসার কমানোর জন্য ডাক্তার দামি ওষুধ দেয়। মাস খানেক ব্যবহারে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বাম চোখও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকেই শাহীন পুরোপুরি অন্ধ।

 

 

ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন নড়াইল তোলারামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এখানেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতি চালু ছিল। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সাইট সেভার্স নামক সংস্থা স্কুলে প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার শেখানোর জন্য ট্রেইনার পাঠান। জজ নামক বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটার শিখানো হতো। কম্পিউটার শিখেন শাহীন।

 

এ সময় শাহীন ক্রিকেট খেলা ও দাবা খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। সদস্য হন যশোর ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাবের। শাহীনের গানের গলাও বেশ ভালো। নজরুল ও রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে নড়াইল সুলতান মঞ্চে একাধিকবার বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ২০১৩ সালে তোলারাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ গ্রেড পেয়ে এসএসসি পাশ করেন তিনি। এতদিন সরকারি খরচে পড়াশুনা চলছিল। এবার উচ্চ শিক্ষার জন্য নিজেদের ব্যয় বহন করতে হবে।

 

শাহীনের ইচ্ছা কলেজে ভর্তি হবে। পরিবারের বললো, তোমার আর পড়াশুনা করার দরকার নেই। ধারণা অন্ধ মানুষ পড়াশুনা করে কি হবে। পরিবার কলেজে পড়ার জন্য টাকা দিতে রাজি হলেন না। রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েলেন শাহীন। বশির ভাইয়ের (আরেক জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) সহযোগিতায় ঢাকায় চলে আসেন। ইচ্ছা মিরপুর বাঙলা কলেজে ভর্তি হওয়ার। ভর্তি হতে আড়াই হাজার টাকার প্রয়োজন। ভর্তি ও ঢাকায় থাকা খাওয়ার খরচ মিটাতে কিছু একটা করতে হবে। বশির ভাই তাকে লায়ন চক্ষু হাসপাতালে লটারি বিক্রির দ্বায়িত্ব দিলেন। প্রতি লটারিতে পাঁচ টাকা লাভ থাকতো শাহীনের। কয়েকদিন লটারি বিক্রিতে বেশ লাভও হলো। মিরপুর যে বাসায় থাকতেন, এক রাতে তার ব্যাগ চুরি হয়ে যায়। ওই ব্যাগেই ছিল মোবাইল, টাকা, ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাগজপত্র। কাগজপত্র না থাকায়, পরের দিন কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় যোগ দিতে পারেননি তিনি। মিরপুর বাঙলা কলেজে পড়া হল না আর। কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি।

 

কলেজে পড়ার ব্যাপারে আবার পরিবারের সঙ্গে কথা বললেন। পরিবার কলেজে পড়ার জন্য কোনোভাবেই টাকা দিতে রাজি হলেন না। বিনা খরচে পড়ার সুযোগ পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজ এলাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত শামসুল হুদা কলেজে ভর্তি হলেন। বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। পরিবার কলেজে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া দিতেও রাজি নয়। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে কলেজে যেতেন তিনি। গ্রামে শিক্ষার হার কম থাকায়, একজন অন্ধ ছেলে কলেজে পড়ছে শুনে সবাই অবাক হতো। কৌতূহলী হয়ে দল বেঁধে দেখতে আসতো অনেকে। অনেকে অনেক প্রশ্ন করতেন। প্রতিদিন হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো তাকে।

 

২০১৩ সালে তিনি ডাচ বাংলা স্কলারশিপ পান। এতে আর্থিক সংকট কিছুটা দূর হয়। কলেজে ব্রেইল পদ্ধতি না থাকায় পড়ালেখা চালিয়ে যেতে কষ্ট হতো। মোবাইলে রেকর্ড করে পড়তে হতো। কলেজের এক শিক্ষক ‘কানা খোঁড়া বদের গোড়া’ বলে প্রায় কটাক্ষ করতেন। ২০১৫ সালে ওই কলেজ থেকেই জিপিএ ৪.৫৮ পেয়ে সফলতার সঙ্গে এইচএসসি পাশ করেন।

 

মিরপুর দুইয়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে তিনি নিয়োগ পেলেন। আট মাস চাকরি করেন। এর মধ্যে ঢাবিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেন। ২০১৫-১৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ পান। ততদিনে পরিবারের ভুল ভেঙেছে। ঢাকা কলেজে পড়ুয়া বড় ভাই সহযোগিতা করেন। ভর্তির পুরো টাকা পরিবার দেন।

 

শাহীন আলম এখন সূর্যসেন হলের ১৬২ নম্বর রুমে থাকেন। অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের তিনি সব সময় সহযোগিতার চেষ্টা করেন। বেশ কয়েকজনকে ব্রেইল শিখিয়েছেন। জজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটার শেখাচ্ছেন। স্মার্টফোন ব্যবহার শেখাচ্ছেন, নিজেও ব্যবহার করছেন স্মার্টফোন। ভবিষ্যতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল গড়ে তোলার আগ্রহের কথা জানালেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর সিলেবাস পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু নতুন ব্রেইল বই প্রিন্ট হচ্ছেনা, এতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা খুব সমস্যায় পড়ছেন।’

 

শাহীনের স্বপ্ন পড়ালেখা শেষ করে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হবেন। স্বপ্ন পূরণের পথে নানা শঙ্কার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

 

শাহীন খুব আপেক্ষ করে বলেন, ‘আমরাও তো মানুষ। কিন্তু স্বাভাবিক মানুষেরা আমাদের অবহেলার চোখে অন্যভাবে দেখে। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর সব মানুষ স্বার্থপর।’

 

লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ নভেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়