ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সনদ নিয়ে হয়রানি, দালালদের লজ্জাজনক ব্যবসা

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সনদ নিয়ে হয়রানি, দালালদের লজ্জাজনক ব্যবসা

হাসান মাহামুদ : অকুতোভয় বীরদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধ, সংগ্রাম আর বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বিলম্বে হলেও সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য সম্মান দিচ্ছে সরকার। আর এই সুযোগ নেওয়ার জন্য কতিপয় অসাধু ব্যক্তি অসদুপায় অবলম্বন করে মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করছে, নিচ্ছে অনৈতিক সুবিধা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘপ্রক্রিয়ার কারণে আসল মুক্তিযোদ্ধারা সনদ পাচ্ছেন না। আর কিছু অসাধু দালাল ও ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে বিক্রি হচ্ছে জাল সনদ। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হচ্ছেন, সাময়িক লাভবান হচ্ছেন অসাধুরা। যদিও জাল সনদ কোনো এক সময়ে ধরা পড়ছে, শাস্তিও হচ্ছে কিন্তু প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপের অভাবে সনদ বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে কেউ চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন, কেউ বা অতিরিক্ত দুই বছর চাকরি করেছেন, এমন উদাহরণও রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব অপরুপ চৌধুরী বলেন, ‘টাকা দিয়ে এ ধরনের সনদ নিয়ে কেউ সাময়িক সুফল পেলেও কোনো না কোনো পর্যায়ে তারা ধরা পড়ছেন। সনদ পরীক্ষা করে ভুয়া প্রমাণিত হলে মামলা ও শাস্তি হচ্ছে। আগামীতেও হবে।

তবে সনদ পেতে দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বিষয়ই একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এটিও তেমনি একটি বিষয়। কতিপয় অসাধু ব্যক্তি এই বিষয়টিকে এতো বেশি নোংরা করে ফেলেছে যে, অনেক সময় সঠিক মানুষটিকেও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কারণ সবকিছু নিরীক্ষা করেই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।’

সচিব আরো বলেন, ‘অবশ্য এখন আগের থেকে বিষয়টি অনেক সহজ হয়েছে। কারণ, এখন অনলাইনেই আসল সনদ পাওয়া যাচ্ছে। সব মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ও সনদ যখন অনলাইনের আওতায় চলে আসবে তখন এই সমস্যা আর থাকবে না।

সনদ ছাড়াই সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা : সনদ না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে সুবিধা নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে দুই সাব রেজিস্ট্রার ও দুই পুলিশ সদস্য চাকরি পেয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ওই চারজনকে চাকরিচ্যুত করার সুপারিশও করেছে দুদক। রাজধানীর শাহবাগে দুটি ও সিরাজগঞ্জ থানায় দায়ের করা একটি মামলার সূত্র ধরে দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত শেষে এ অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে গত আগস্ট মাসে চার্জশিট দেয় দুদক।

দুদক সূত্র জানায়, এইচএসসি পাশ সত্ত্বেও বিএ (সম্মান) পাশের জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি পান মিনতি দাস নামের ব্যক্তি। বর্তমানে তিনি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায় কর্মরত রয়েছেন। চাকরিতে যোগদানের পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিনতি দাস অবৈধভাবে বেতন-ভাতাদি বাবদ সরকারের ১০ লাখ ৯২ হাজার ৭শ ৬৮ টাকা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একইভাবে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি পাশের জাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের বাড্ডা সার্কেলে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন পরিতোষ কুমার দাস।

দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক (সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১) আহামদ ফরহাদ হোসেন এ দুটি মামলার তদন্ত করেন।

অন্যদিকে দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক (সমন্বিত জেলা কার্যালয়, পাবনা) আবুল কালাম আজাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে আব্দুল মজিদ নামে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাসিন্দা তার খালুর ছবের আলীর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জাল করে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি নেন। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এসআই পদে চাকরি নেন নুরে আলম সিদ্দিকী। আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট প্রদানে সহায়তা করেছেন তাদের খালু মুক্তিযোদ্ধা মো. ছবের আলী। যিনি পুলিশের ভেরিফিকেশন রিপোর্টেও দুজনকে ছেলে দাবি করে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এদিকে ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আর্থিক অসচ্ছল দাবি করে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অর্থ-সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করেন ধানমন্ডি এলাকার সাংসদ ফজলে নূর। অথচ তাদের কারও নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ছিল না। আবার সূত্রাপুর এলাকার সাংসদ মিজানুর রহমান ৩২ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে অর্থ-সহায়তা দেওয়ার আবেদন করেন। তাদের মধ্যে ১১ জনের নাম কোনো তালিকায় ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, ‘এরা সবাই ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেছিল। হয়তো সংসদ সদস্যদের কাছে যখন তারা তাদের সনদ দেখিয়ে চাকুরির সুপারিশের জন্য বলেছিল তখন তো ম্যানুয়ালি সেসব পরীক্ষা করার সুযোগ ছিল না। আর এই সুযোগটি নিয়েছিল ওসব ব্যক্তি।

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অপচেষ্টা অহরহই হচ্ছে, আমাদের নজরে আসলে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসলে তখন বিষয়গুলো জানাজানি হয়, না হলে সেসব ‘প্রকৃত’ হিসেবেই থেকে যাচ্ছেন।

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘শুধু সরকারি চাকরি গ্রহণ করতে গেলে সনদগুলো খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দিয়ে অনেক ধরনের সুবিধার প্রচলন রয়েছে দেশে। যারা অসাধু তারা তো অন্য সব সুবিধা নিচ্ছেই। এসব সুবিধা নেওয়াও বন্ধ হবে। তবে কিছুটা সময় লাগবে।’

জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরির অভিযোগ অসংখ্য : জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরির বয়স বাড়ানোর অভিযোগ উঠে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের একজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আব্দুস সোবহান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব সুনীল কান্তি বোস-এর মতো শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও।

মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেড় হাজার লোক নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। পুলিশ বাহিনীতে অনেকে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন। এরই মধ্যে কয়েক দফায় ৫০ জনের বেশি লোকের চাকরি গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োগেও একই অবস্থা হয়েছে বলে জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১১ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা এক হাজার ৩৩৮ জনের মধ্যে ১৫২ জনের সনদই ছিল ভুয়া। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগেও ঘটে একই ঘটনা।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার অবসরের বয়স দুই বছর বাড়ানোর পর অনেকেই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে আবেদন করেন। এ রকম আবেদনকারী ২৫ জন পদস্থ কর্মকর্তার সনদ সন্দেহজনক চিহ্নিত করে তদন্ত হয়। তদন্তে বেশ কয়েকজনের জাল সনদ চিহ্নিতও হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর জাল করেও কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর তদন্ত এবং যাচাই-বাছাইয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।

প্রকৃত সনদে সামান্য ত্রুটি সমাধানে দুর্ভোগ অনেক : ২২ নভেম্বর, বুধবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে অভিযোগের সুরে বলেন ‘স্যার, আমার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা হলো কেন? আমি তো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা না। আমি অমুক মন্ত্রীর সঙ্গে একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছি।’ জবাবে সচিব জানালেন, পুলিশ বিভাগ থেকে যে সনদ মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এসেছে, সেটির নম্বর ও তার সনদের নম্বর আলাদা।

ওই মুক্তিযোদ্ধাকে সচিব বোঝাচ্ছিলেন এবং তিনি উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, ‘আমি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নই, আমাকে কেন এটা বলা হলো?’ সচিব বলছিলেন, ‘বাবা, আপনাকে ভুয়া বলা হয়নি। যে সনদটি এসেছে সেটি মন্ত্রণালয়ের মূল সনদের সঙ্গে মেলে না। এটা ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে।’

জানা যায়, ওই মুক্তিযোদ্ধার ছেলে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি নিয়েছেন। কিন্তু সত্যায়িত যে সনদ জমা দেওয়া হয়েছে তাতে সমস্যা রয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সচিব ফাইল দেখে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিলেন।

পরে সচিবের রুমের বাইরে সেই মুক্তিযোদ্ধার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি জানান, চার মাস আগে তার ছেলের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে তদন্ত শুরু হয়। কারণ, তার সনদের নম্বরের সঙ্গে নাকি মন্ত্রণালয়ের সনদের নম্বর মিলছিল না। এ নিয়ে তিনি অসংখ্যবার মন্ত্রণালয়ে এসেও সমাধান পাননি বলে তিনি জানান। শেষে তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিষয়টি এখনো সমাধান হয়নি।

সামগ্রিক বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এত দিন মুক্তিযোদ্ধা কারা, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা ছিল না। যে কারণে নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এসেও সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। যাকে-তাকে সনদ দেওয়া হয়েছে। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ ধরনের হাজার হাজার অভিযোগ পাচ্ছি। এ অবস্থায় আমরা এসব বিষয় হালনাগাদ করছি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্থায়ী ‘ডিজিটাল সনদ’ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি এসব সমস্যার সমাধান শিগগিরই হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়