ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কালো বর নিয়ে কেন এতো ঝড়!

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪০, ৩০ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কালো বর নিয়ে কেন এতো ঝড়!

রুহুল আমিন : সুমাইয়া শিমু। বিনোদন জগতে, বিশেষ করে নাট্যজগতে বেশ পরিচিত ও সফল অভিনেত্রী। ২৮ আগস্ট পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছেন তিনি। বর নজরুল ইসলাম।

 

নজরুল ইসলাম নিউজিল্যান্ডের মেসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস করেছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। আর শিমু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে এমএসএস ও ড্রামাটিকস বিভাগ থেকে পিএইচডি করছেন। যোগ্যতায় কেউ কারো চেয়ে কম নন। আপাতদৃষ্টিতে দুজনের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য হচ্ছে শিমুকে অনেকে চেনে। যারা নাট্যজগতের খোঁজখবর রাখেন, তারা শিমুকে চেনেন। সেই তুলনায় নজরুল ইসলাম একেবারেই অচেনা। পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রেটি যা-ই বলি না কেন, নজরুল ইসলামের চেয়ে শিমু এখানে এগিয়ে। আমার লেখার বিষয় তাদের যোগ্যতা নয়।

 

সামাজিক রীতি-নীতি মেনে দুই পরিবারের সম্মতিতে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আসলেই কি তাই? আমাদের কিছু আসে যায় না? গত দুই দিনের সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের নিউজ ফিডে গেলে তো তা মনে হয় না। শিমুর বর নজরুল ইসলামের গায়ের রং কালো। আর এই নিয়েই যত সমস্যা আমাদের। যেন শিমু কালো বর বিয়ে করে আমাদের বাড়া ভাতে ছাই ছিটিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে মনে হয়েছে, ফেসবুকে তো আর সবাই সিরিয়াস ইউজার না। কিছু হুজুগে বাঙালি থাকতেই পারে। যারা অন্যের জীবনযাপন, অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ান এবং তিল পরিমাণ ত্রুটি পেলে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলেন। ‍নজরুল ইসলামের গায়ের রং নিয়ে যেসব মন্তব্য ও স্ট্যাটাস ফেসবুকে চোখে পড়েছে, তা সত্যিই মানুষ হিসেবে লজ্জাজনক। শুধু আমার কাছে নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এটা লজ্জার।

 

একবার ভাবুন- পাত্রী শিমু নয়। বর নজরুল ইসলামই। তাহলেও কি এমন কুরুচি দেখাতাম আমরা? আসলে দেখানোর সুযোগই থাকত না। কারণ তা মিডিয়াতে আসতো না। শিমুর বর নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন জনের কর্মকাণ্ড দেখে আমার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছে। শিমু সেলিব্রেটি। সেলিব্রেটিদের জীবনযাপন কিছুটা হলেও পাবলিক ফলো করে। খোঁজ-খবর রাখে। এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সেলিব্রেটির ব্যক্তি জীবন বলতে কি কিছু থাকবে না? আর সেলিব্রেটি হিসেবে যদি শিমুকে পছন্দই করি তাহলে তার প্রাপ্য সম্মান তো তাকে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কি তাকে তা দিয়েছি। একজন সেলিব্রেটি হিসেবে তো নয়ই, একজন মানুষ হিসেবেও শিমু সম্মান পায়নি। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তা হলো- যারা নজরুল ইসলামের গায়ের রং নিয়ে কথা বলছেন তারা সবাই মোটামুটি ‘শিক্ষিত’। আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলছি। আর শিমুকে যারা নামে এবং তার পেশায় চিনে তারা অবশ্যই পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর কেউ না। হ্যাঁ, হয় তো তারা নব্য শহুরে কিন্তু তারা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পরা মানুষদের রিপ্রেজেন্ট করে না। তারা যখন একজন মানুষের গায়ের রং কালো না ফর্সা তা নিয়ে কথা বলেন, তখন তা সত্যিই উদ্বেগজনক। তাহলে কি আমরা হঠাৎ করে বর্ণবাদী হয়ে উঠলাম? নাকি আমাদের রক্তেই প্রোথিত ছিল বর্ণবাদের বীজ? কেউ কেউ তো দেখলাম সরাসরি বলছেন, শিমু লোভী। কারণ বরের টাকা আছে তাই এমন কালো হওয়া সত্বেও তাকে বিয়ে করেছেন। আমি জানি না, ‍শিমু বা নজরুল দুজনের একজনের কেউ ফেসবুকে এসব দেখেছেন কিনা। দেখে থাকলে বলব- দুঃখিত শিমু-নজরুল, আমরা এখনো সভ্য হয়ে উঠিনি। আর এমন দেশে জন্মালে এ ধরনের আচরণের মুখোমুখি হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমা করবেন আমাদের। আমাদের এরূপ অসভ্য আচরণের ছোঁয়া যেন আপনাদের নতুন জীবনে না লাগে সে কামনা করি।  

 

বাংলাদেশের মানুষ আর যা-ই হোক বর্ণবাদী, এটা আমি বিশ্বাস করি না। অতীতেও এমন হয়নি কখনো। তারপরও এমন ঘটনা কেন ঘটল? আমার ব্যক্তিগত মত হলো- আমরা পাবলিক ফিগারদের ট্রিট করার মানসিকতায় এখনো পরিপক্কতা অর্জন করতে পারিনি। সেটা সাংবাদিক থেকে শুরু করে আপামর ফেসবুকিয়ান সে যে-ই হোক। পাবলিক ফিগারদের কর্মকাণ্ডকে এমনভাবে মানুষ ফলো করে যে, তাদের পান থেকে চুন খসলেই ‘মহাভারত অশুদ্ধ হলো’ ভাবি আমরা। তাই এটিএম শামসুজ্জামানকে ছয়বার মেরে ফেলতেও আমাদের বাধে না, নায়ক রাজ রাজ্জাককে মেরে ফেলতেও আমাদের বাধে না। সম্মান দিই না।

 

আর সংবাদ মাধ্যমে নিউজের শিরোনাম করি- আবার বিয়ে করলেন ‍ওমুক, তমুক। সংসার ভাঙল ওমুকের তমুকের। অন্যকে নীচ করে যেন আমরা মনে শান্তি পাই, আনন্দ পাই। নজরুল ইসলামকে কালো বলে প্রথমে নিজেকে অসম্মান করলাম, পরে তাকে অসম্মান করলাম, একজন সেলিব্রেটিকে অসম্মান করলাম, সর্বোপরি একজন মানুষকে অসম্মান করলাম। আমাদের সংস্কৃতিজগতে মেধাবীদের আকাল চলছে। আর এই অসম্মানও আকালের কারণ। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে কে চায়। তাই মেধাবীরা আসেন না।

 

কারো গায়ের রং নিয়ে কিছু বলার আগে আমাদের অন্তত ভাবা উচিত, সব একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিই সমান। বর্ণবাদী আচরণ মানুষকে মানুষ রাখে না পশুতে রূপান্তর করে। এটা ইউরোপ আমেরিকা হলে তাও মানা যেত, এই দেশের জন্য তা লজ্জার।

 

লেখাটা শেষ করব বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়ার করুণ এক অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমি তখন সাইপ্রাসে। কাজ নেই। সকালে বের হই কাজ খুঁজতে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। কোনোদিন কাজ মেলে, কোনোদিন মেলে না। আসলে খুঁজছিলাম একটা পার্মানেন্ট জব। তো একদিন কাজ খুঁজতে সাইপ্রাসের এক গ্রামে চলে গেলাম। সেখানকার গ্রাম আমাদের গুলশান-বনানীর চেয়ে অনেক সুন্দর ও মনোরম। হাঁটতে হাঁটতে একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, এক পরিচিত বড় ভাই সেখানে কাজ করেন। উনি ডাকলেন। কাছে গেলাম। উনি কাস্টমারদের গাড়িতে তেল দিচ্ছেন আর আমার সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় ২৬ কি ২৭ বছর বয়সি একটি ছেলে পাম্পে এসে পেট্রোল দিতে অর্ডার দিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন। তার সঙ্গে একটি কালো কুকুর ছিল। ও হ্যাঁ বলে রাখি, গায়ের রং কালো এবং শ্যাম হওয়ার কারণে এশিয়ানদের তারা মাব্রো (কালো) সম্বোধন করত। তো ছেলেটি এটা সেটা বলার এক পর্যায়ে ওই ভাইকে বললেন, এই দেখ (কুকুর দেখিয়ে) তোর ভাই। ওই ভাই তখন আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলেন। আমি-বড় ভাই, দুজনের একজনও কোনো কথা বললাম না। সেই দিনের স্মৃতি আজো মনে হলে চোখ ছল ছল করে। কতটা অসহায় ছিলাম সেইসব দিনে।

 

শিমু-নজরুল দম্পতির সুখি জীবন কামনা করছি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৫/রুহুল/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ