ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পরীক্ষা দিয়ে রাজা

মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ২৯ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরীক্ষা দিয়ে রাজা

মিলন আশরাফ : চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ইন্টারভিউ বিষয়টি খুব পরিচিত। পেশা প্রবেশের প্রাথমিক পদক্ষেপ এটি। চাকরিদাতা সাক্ষাৎকার বা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য কর্মী বাছাই করেন। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ে রাজা নির্বাচন? এমন ঘটনা রীতিমত অবিশ্বাস্য। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। তাও আবার ভারতবর্ষে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতের বরোদা রাজ্যে এ রকম ঘটেছিল। বরোদা রাজ্যের তৃতীয় গাইকয়ার্ড সোয়াজি রাও ছিলেন সেই রাজা। তিনি রাজপুত্র ছিলেন না। পরীক্ষা দিয়েই তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন। তখন চলছিল ব্রিটিশ শাসন। বরোদা রাজ্যও তখন ব্রিটিশদের আয়ত্বে। সে সময় যিনি মহারাজ ছিলেন, তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কোনো সন্তান না রেখেই মারা যান তিনি। ব্রিটিশ মহারানি তখন রানি লামনাবীকে নোটিশ পাঠান। সেখানে লেখা ছিল, যত দ্রুত সম্ভব রাজ্যে রাজা নির্বাচন করতে হবে। না হলে ব্রিটিশ সরকার রাজ্য পুরোপুরি তাদের দখলে নিয়ে নেবে।

 

মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন রানি লামনাবী। কী করা যায় ভেবে ভেবে তিনি অস্থির। ইংরেজদের হাত থেকে রাজ্য রক্ষা করতে যে করেই হোক রাজা নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু রাজ্যের বেশিরভাগ লোক অশিক্ষিত, কাকে করবেন তিনি রাজা? কোনো যোগ্য ও বিশ্বস্ত লোক তার চোখে পড়ল না। তিনি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। হঠাৎ তার মনে চমৎকার একটা ভাবনা এলো। তিনি ঠিক করলেন গ্রামের মানুষদের মধ্যে থেকে তিনি বেছে বের করবেন কাঙ্ক্ষিত সেই রাজাকে। তিনি তার বা রাজ্যের কারো সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই এমন একজনকে রাজা মনোনীত করবেন। এমনকি রাজ্যের কারো সঙ্গে চেনাজানাও নেই এমন লোকই তার পছন্দ। পোষ্যপুত্র বানাবেন অচেনা একজনকে। তারপর তার হাতে তুলে দেবেন রাজ্যের ভার। সিদ্ধান্তে অটোল থেকে তিনি অধীনস্তদের আদেশ দিলেন, কাবলানা (তার নিজের গ্রাম) থেকে বারো বয়সের কম বালকদের জড়ো করতে।

 

রানির আদেশ। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল তার গ্রামে। লোকেরা গিয়ে ডেকে নিয়ে এলো গ্রামের ছেলেদের। একেবারে দিনমজুর থেকে শুরু করে গৃহস্থ ঘরের ছেলে কেউ বাদ গেলো না। টানটান উত্তেজনা। যাদের ডেকে আনা হয়েছে তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবে বরোদা রাজ্যের রাজা। পরীক্ষা নেওয়ার কায়দাটাও রানি নিজেই ঠিক করলেন। এক বিচিত্র পদ্ধতিতে তিনি রাজা বানাবেন। প্রথমে তিনি বড় এক টেবিলে দামি দামি খাবার সাজাতে বললেন। গ্রামের সব ছেলেকে একসঙ্গে টেবিলে বসিয়ে খেতে দিলেন। রানি ঠিক করলেন, এই খাবার টেবিল থেকেই তিনি খুঁজে বের করবেন সেই ছেলেকে। তিনি ছেলেদের মেধা, বুদ্ধি, ভদ্রতা ও জ্ঞান এভাবেই যাচাই করবেন।

 

সব ছেলেরা একসঙ্গে টেবিলে খেতে বসেছে। সামনে রাজ্যের যত মজার খাবার ছিল সবই থরে থরে সাজানো। গাঁয়ের গরিব ছেলেরা এসব খাদ্য কোনোদিন চোখেও দেখেনি। একসঙ্গে সবাই হামলে পড়ল। কিন্তু যেহেতু রাজ দরবার, তাই তাদের একটু ভয় ভয়ও করছিল। তাছাড়া তাদের একেবারে সামনে বসেছিলেন স্বয়ং রানি। তিনি মনোযোগ দিয়ে ছেলেগুলোর আচরণ লক্ষ্য করছিলেন। যার আচরণ সবচেয়ে ভালো লাগবে তাকেই পুত্ররূপে গ্রহণ করবেন তিনি। সবাইকে সেজন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছিল। খুব সাবধানে খাচ্ছিল সবাই। আদব কায়দা বজায় রাখতে চেষ্টা করছিল অনেকে। কিন্তু তাদের মধ্যে গোপাল রাও ছিল সবচেয়ে দুষ্টু ও চঞ্চল। তার বাবা ছিল সামান্য দিন মজুর। গোপাল দেখতে শুনতে ভালোই ছিল। কিন্তু স্বভাবটা বেয়ারা। তার মাথার মধ্যে ওসব রাজাটাজা হবার কোনো বাসনা ছিল না। সে মূলত বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিল। রানিমাকে দেখতে পাওয়া যাবে এটা ছিল তার জন্যে বড় পাওয়া। এই ভেবেই তার রাজ দরবারে আসা।

 

দরবারে এসেও গোপাল রাও চুপচাপ বসে ছিল না। রানি সামনে বসে আছেন, সেদিকেও তার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দুষ্টুমি করেই যাচ্ছে। দরবারে বড় বড় সৈন্য সামন্ত দেখে তার বুক একটুও কাঁপল না। কোনো ভয় যেন তাকে স্পর্শই করল না। হঠাৎ রানির নজর পড়ল গোপাল রাও-এর ওপর। ছেলেটির ভয়হীন কাণ্ড, সারল্যমাখা চাউনি, মায়াভরা মুখ, নির্ভীক ব্যক্তিত্ব দেখে রানি মুগ্ধ হলেন। তিনি গোপালকে রাজ দরবারের অন্দর মহলে ডেকে নিয়ে গেলেন। পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন তাকে। এই গোপালই বসলেন বরোদার রাজ সিংহাসনে। বরোদা রাজ্য ৬৪ বছর শাসন করেছিলেন গোপাল রাও।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ নভেম্বর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়