ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বাকিংহাম প্রাসাদের দুর্দশা!

গোবিন্দ তরফদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৬, ২৪ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাকিংহাম প্রাসাদের দুর্দশা!

গোবিন্দ তরফদার : ইংল্যান্ডের রানির বাসভবন হিসেবে পরিচিত ‘বাকিংহাম প্যালেস’। এই প্রাসাদ সমগ্র ইংল্যান্ডের গর্ব। বাকিংহাম প্রাসাদ সবাইকে স্বাগত জানায় রানীর মতো। বিশ্বের সকল বড় বড় নেতারা অবাক হয়ে যায় ইংল্যান্ড সফরে গেলে, বাকিংহাম প্রাসাদের রাজকীয় ভোজ, প্রাসাদের বাইরে অপেক্ষমান রুপকথার সাদৃশ্য গাড়ি তাদের সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করে দেয়।

 

অতিথিরা বাকিংহাম প্রাসাদে রাজকীয় অ্যাপায়নে তাদের জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ একটা দিন শেষে, প্রাসাদের সবচেয়ে বড় গেস্ট রুম, অর্লিন্স রুমে থেকে বিশ্রাম নেন। কিন্তু যদি তারা বাথরুম ব্যবহার করতে চান তাহলে তাদের একটু বেশি অবাক হতে হয়, কারণ যদি তারা এটা ব্যবহার করতে চান তাহলে তাদের করিডোর এর নিচে গিয়ে কাজটা সম্পন্ন করতে হয়।

 

এখনকার দিনে সবচেয়ে কম দামি হোটেলগুলোতেও এর থেকে ভালো ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু রানির সবচেয়ে প্রিয় অতিথি জাপানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী থেকে শুরু করে বারাক ওবামা পর্যন্ত সবাইকে এক রুমেই দাঁত পরিষ্কার করতে হয়েছে।

 

তাই বাকিংহাম প্রাসাদের পুনঃসাজসজ্জার প্রয়োজন শুনে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাকিংহাম প্রাসাদ সংস্কারে ৩৬৯ মিলিয়ন ইউরো খরচ করা করা হচ্ছে, এ খবর অবাক করবে না এখানকার সাবেক অতিথিদের। ভিআইপি অতিথিদের ওয়াশিংরুম ব্যবস্থা উন্নত করার পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, তা রয়েছে কাজের তালিকার একেবারে নিচের দিকে।

 

কিছুদিন আগে আগামী ১০ বছরের সেবা প্রোগ্রাম প্রকাশ করেছে রাজ কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে এটাই সবচেয়ে বড় সেবা প্রোগ্রাম প্রকাশ করেছে রাজ কর্মকর্তারা। ১৯৯২ সালে আগুন লেগে ক্ষতি হবার পরে উইন্ডসর ক্যাসেল (রানীর অন্যতম আরেকটি প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত) পুনরুদ্ধার করতে যে সময় লেগেছিল তার থেকে কম সময় লাগবে এবং ওই সময়ে যে খরচ হয়েছিল তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ লাগবে এবার সম্পূর্ণ কাজটা শেষ করতে।

 

কিন্তু এই স্থাপত্যের মধ্যে যে বিদ্যুতিক তারের নকশা করা হয়েছে তা ১৯৪৯ এর সময়ের। ওই সময়ে রাজা ছিলেন ষষ্ঠ জর্জ।

 

 

ইংল্যান্ডের সারেতে অবস্থিত ক্লানডন পার্ক-এর ঘটনা এক্ষেত্রে নিরাপত্তা সচেতনতার একটি শিক্ষা প্রদান করে থাকে। গত বছর এটিতে আগুন লেগে যায় কারণ ন্যাশনাল ট্রাষ্ট এটার পুরাতন ইলেক্ট্রিক্যাল বোর্ডগুলো চেঞ্জ করেনি। বাকিংহাম প্রাসাদের মধ্যেও এরকম ৯২ শতাংশ ইলেক্ট্রিক্যাল বোর্ড আছে, যেগুলো অতিসত্ত্বর পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

 

প্লাস্টারের ছোট ছোট টুকরা ভেঙে পরছে বেশ কয়েক বছর ধরে। কয়েকদিন আগে রাজকুমারী একটুর জন্যে বেঁচে গেছেন এরকম একটি টুকরার আঘাত থেকে। এছাড়া প্রায় ২০ বছর আগে ২৮ বছর বয়সী নিক হলওয়েকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল বল রুমের একটা বড় প্লাস্টার খশে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায়। সে সময় বলরুমে তিনি তার বাবার ওবিই গ্রহণ করা দেখছিলেন।

 

২০০২ সালের রানির সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সময় এক বীভৎস ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন অনেকেই। বাগানে ওপেন এয়ার পপ কনসার্ট হবে, সবাই অপেক্ষা করছিল উন্মুখ হয়ে, কিন্তু ঘটে যায় একটি বড় দুর্ঘটনা। প্রাসাদের চিলাতে বিশাল আগুন লেগে যায়, আর তার ঠিক নিচে ছাদে ২ টনের আতশ বাজি রাখা ছিল।

 

যা হোক, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রাসাদে আগুন লাগার পরে এবারের পদক্ষেপটাই হচ্ছে, সবচেয়ে বড় এবং সর্বপ্রথম যেখানে পুরো রাজপ্রাসাদের সংস্কারমূলক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজ কর্মচারীরা এখনও শিউরে উঠেন কিভাবে তারা রাজকীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে গাই ফোক্স মোমেন্টের মুখোমুখি হয়েছিল। বছরের পর বছর সে মেরামত কার্য সম্পাদন হয়ে এসেছে যেটাকে একটা সেই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বহুল প্রচলিত প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়, ‘উন্নত করার লক্ষ্যে সংশোধনীকরণ।’

 

এটা আসলে কোনো ভালো সমাধান হতে পারে না যে, ছাঁদের নিচের অমূল্য সব পেইন্টিংকে বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচাতে ছাঁদে বালতি বসানো।

 

রানির স্পষ্ট মনে আছে, উইন্ডসর ক্যাসেলের অগ্নিকান্ডের পর পরই জন মেজরের সরকার প্রাথমিকভাবে কথা দিয়েছিল যে, সংস্করণে অর্থায়ন করবেন তারা। তবে সামার ট্যুর এর মাধ্যমে টাকা উঠেছিল শেষমেষ।

 

 

দুইটা জিনিস সর্বদাই তাকে খুব খোঁচা দিত, সেটা হল প্রাসাদের দৈনন্দিন কার্যের পরিবর্তন এবং আরেকটা হল অধিক ব্যায়বহুলতা। প্রাসাদটিকে পুণরায় ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হচ্ছে। ফাটলের ওপর প্লাস্টার করাই হয় যেন এটা আরো অনেক দিন টিকে থাকে। তবে এটা দীর্ঘ পরিকল্পনার মধ্যে পরে না। তাই এখন দরকার খুব ভালো করে এই প্রাসাদের পুনঃসংস্করণ।

 

নব্বই এর সময়ে একবার আই আর এ মর্টার এর একটা হামলা যেটা কিনা ডাউনিং স্ট্রিট এ সরাসরি আঘাত এনেছিল, তখনও এটা প্রাসাদের কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করেনি। এমনকি রাস্তার এমন ক্ষতির ফলেও প্রাসাদের কোনো কাঠামোর কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

 

২০২৫-২৬ সালে এই প্রাসাদের ১০০তম জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে এই সংশোধনিতে কাঠামোর পরিবর্তনের বিষয়টা প্রাসাদের প্রাইভেট অ্যাপার্টমেন্ট অবদি যায়নি। ১৭৬১ সালে তৃতীয় জর্জ যত টাকা খরচ করে নিজেদের থাকার জন্য এই বাসাটি কিনেছিলেন তার থেকে প্রায় ১৩০০০ গুণ বেশি খরচ করা হচ্ছে পুনঃসংস্করণের কাজে।

 

অনেকে আবার বলেছেন এই খরচের টাকা যেন রানির ব্যক্তিগত খাত থেকে দেন, ঠিক যেমন উইন্ডসর বিল্ডিংয়ে আগুন লাগার পরবর্তী সংস্করণের সময় যেভাবে করা হয়েছিল একদম ওইভাবেই যেন করা হয় এবারও।

 

কিন্তু এইবার রানি বেশ কিছুটা পাবলিক সহানুভুতি আশা করছেন। প্রথমত তিনি একা নন। পৃথিবীর অনেক মহামুল্যবান নিদর্শন হুমকির মুখে পড়েছে এবার। এই সপ্তাহে যেটা শোনা যাচ্ছে হোয়াইট হাউসে কিছু সংস্কারমূলক কাজের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এক বছরের জন্য ওভাল অফিসে তার যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে হতে পারে।

 

ওয়েস্টমিনস্টার এর মতে, এটা আসলেই একটি বড় কাজ। কারণ সম্পূর্ণ প্রাসাদকে নতুনভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঢেলে সাজানো হবে। যদিওবা বাকিংহাম প্রাসাদ দীর্ঘ সময় নিয়ে নির্মিত হয়েছিল তবুও এই সংসদের অধিকাংশ একটি ভয়ানক অবস্থায় রয়েছে। একদম ভিত্তি থেকে কাজ শুরু করলে এটি একটি ব্যাপক পরিবর্তন সাধন হবে যে তা করতে অনেক সময় লাগবে প্রায় ২০২০ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে। আর বাকি ছয় বছর লাগবে পুণরায় সাজসজ্জা আগের মতো ফিরিয়ে আনতে।

 

 

এর সম্পূর্ণ খরচ প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড, তবে এটা অতিক্রম করে ৭ বিলিয়ন পাউন্ডে গিয়ে থামতে পারে। সুতরাং, রাজকীয় দপ্তরে পুনরূদ্ধার খরচ ওয়েস্টমিনস্টার বিল এর ১০ শতাংশ কম হতে পারে। এই বিল্ডিং তাদের জাতীয় নিদর্শন তথা তাদের পরিচিতির একটা অংশ হিসেবে কাজ করে।

 

এমনকি এটা তাদের অর্থনীতিতে একটা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। লন্ডন মেয়রের অর্থনৈতিক একটা পরিকল্পনা এটাকে ঘিরে রয়েছে, কারণ এই প্রাসাদের প্রতি সকল পর্যটকের একটা আকর্ষণ রয়েছে রাজধানীর বুকে।

 

যদিওবা এটা রানির এখন ব্যক্তিগত বাসা না। এটা রাস্ট্রের অধীন। ৭৭৫টা রুমের মধ্যে রানি মাত্র ১০টি ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্ট পান যেটা ডিউক অব এডিনবরা নির্ধারণ করা আছে।

 

প্রাসাদের বেশিরভাগটা জুড়ে অনেক অফিস রয়েছে। ১৬টা জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় এইখানে কর্মরত ৩০০ জন কর্মকর্তার দ্বারা। বাকি যেগুলা বাকি থাকে তা অতিথিদের থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়।

 

এখানে শুধুমাত্র বিশ্ব নেতারা আমন্ত্রিত হন না। প্রায় ৯০০০০ সাধারণ মানুষ অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পায়। ৪০০০০ এর বেশি মানুষ গার্ডেন পার্টিতে আসে। এটা একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।

 

এই সকল কিছুর কারণে রানি এবং ডিউক অব এডিনবরা প্রথম প্রাসাদে থাকার ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন ছিলেন। এটা কখনই একটি বাসা হতে পারেনা। এই সকল কথা চিন্তা করে ১৯৩৬ সালে রানি তার পদটাকে প্রত্যাখান করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পরবর্তী তিন বছর তিনি উইন্ডসর অথবা স্কটল্যান্ড এ ছিলেন।

 

 

রাজকুমারী এলিজাবেথ ডিউক এর সঙ্গে বিয়ে করার পর তিনি যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তারা দুজনে মিলে ক্ল্যারেন্স হাউসটাকে তাদের পারিবারিক বাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তারা ক্ল্যারেন্স হাউস এ থাকতেন আর বাকিংহাম প্রাসাদে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ডিউক চলে যাবার পড়ে রানিমা আর প্রাসাদে যেতে চান না।

 

উইনস্টন চার্চিল তাকে একরকম বাধ্য করেন প্রাসাদে থাকার জন্য। তিনি বুঝান যে, প্রাসাদে থাকা সম্রাজ্ঞীর দায়িত্ব এবং রাজকীয় বাসা বদল হয় অবশেষে।

 

আজ প্রাসাদের বেশিরভাগ জায়গা অবিলম্বে কুইন ভিক্টোরিয়া মনে করে দেখতে পারেন। রান্নাঘরে যে সকল প্যানে করে রান্না করা হয় তাতেও তার সাংকেতিক নাম ভিআর খোদাই করা আছে। যাই হোক, আধুনিকীকরণ এখনও পিছিয়ে আছে।

 

বাকিংহাম প্যালেস তাদের জাতীয় নিদর্শনের থেকে অনেক বড় একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং এটা একটি নিছক ব্রিটিশ ভার্সাইলস চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটা একটি অনিশ্চিত বিশ্বের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতার চূড়ান্ত প্রতীক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়