ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যারা হাঙর দিয়ে নাশতা করত, তারা আজ নেই

মাহফুজ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:২২, ৪ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যারা হাঙর দিয়ে নাশতা করত, তারা আজ নেই

মাহফুজ হাসান : ৩৬০ মিলিয়ন বছর আগের কথা, পৃথিবীজুড়ে বলতে গেলে তখন শুধু মাছেদের রাজত্ব! স্থলভাগে তেমন কোনো  বড় আকৃতির প্রাণী ছিল না। সবচেয়ে বৃহদাকার সৃষ্টিগুলো সাগরের তলদেশ দাপিয়ে বেড়াত। তেমনি এক দানবীয় প্রাণী ছিল ডাঙ্কলেওসটাস (Dunkleosteus).

 

সাগরজুড়ে ডাঙ্কলেওসটাসের মতো দৈত্য আর দ্বিতীয়টি ছিল না। এদের দৈর্ঘ ছিল প্রায় ১০ মিটার (৩২.২৮ ফুট)। প্রচণ্ড শক্তিশালী এ মাছের পুরো শরীর মোটা  আচ্ছাদনে ঢাকা ছিল, যা ঢালের মতো কাজ করত।  চোয়ালের পাশ দিয়ে বের হয়ে থাকা ধারালো হাড়গুলো ডাঙ্কলেওসটাসকে ভয়ানক এক শিকারিতে পরিণত করেছিল। হাঙর ছিল এদের সকালের নাশতা!

 

বড় আকারের ট্যাঙ্কের মতো ডাঙ্কলেওসটাসদের দেখলে মনে হতো এদের বোধ হয় যেকোনো কিছু সামলে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এদের হাতে তখন আর তেমন সময় অবশিষ্ট ছিল না, সাগরতলের ৭৯ থেকে ৮৭ শতাংশ প্রাণী তত দিনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণবিলুপ্তির ঘটনা ছিল এটা। খুব পরিষ্কারভাবেই সাংঘাতিক কোনো কিছু ঘটেছিল, কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কী ছিল? ঠিক কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মতো প্রত্যক্ষ কোনো কারণ না থাকলেও ধারণা করা হয়, খুব স্বাভাবিক কোনো কিছু ধারাবাহিক অস্বাভাবিক ফলাফলের জন্ম দিয়েছিল, যার জন্য শেষ পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হয় প্রাণীগুলোকে।

 

ইতিহাসের পাতায় মাছেদের এই যুগ ‘ডেভোনিয়ান কাল’ হিসেবে পরিচিত। সেটা বলতে গেলে ৪১৯ থেকে ৩৫৯ মিলিয়ন বছর আগের কথা, পৃথিবীতে প্রথম ডাইনোসরের আবির্ভাবেরও বহু আগে।

 

স্থলভাগে যদিও তখন হাতে গোনা কিছু প্রাণী ছিল, সাগরদেশ ছিল যেন প্রাণীবৈচিত্র্যের এক অভয়ারণ্য। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় জীবাশ্ম দিয়ে তৈরি প্রবাল প্রাচীরে সে যুগের অনেক প্রাণীর দেহাবশেষ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়।

 

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবিষয়ক জীববিজ্ঞানী  মাইকেল কোটসের মতে, এই প্রবাল প্রাচীরগুলোতে প্লাকোডার্ম মাছ ত্রিমাত্রিক অবস্থায় অত্যন্ত যত্নে সংরক্ষিত হয়। তিনি মনে করেন, এ রকম অদ্ভুদ সুন্দর সৃষ্টি এখন পৃথিবীতে আর নেই। ডেভোনিয়ান কালের প্রাণীদের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও এখন ইতিহাসের পাতাতেই কেবল টিকে আছে।

 

ডেভোনিয়ান প্রবাল প্রাচীর যেসব প্রবালে নির্মিত, তাদের মধ্যে নিম্নস্তরের  খাদক ট্রাইলোবাইটস ও অ্যামোনাইটস এবং শক্ত আচ্ছাদনবিশিষ্ট প্লাকোডার্ম মাছ যেমন ডাঙ্কলেওসটাস এরা সবাই বলতে গেলে রীতিমতো একধরনের ঢাল ব্যবহার করত, কিন্তু কেন করত এটা স্পষ্ট নয়।

 

৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর বিলুপ্তির একটি পরিষ্কার কারণ ছিল। ধারণা করা হয়, একটি বিশাল উল্কাপিন্ডের আঘাতে পৃথিবীর বুকে ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে যায়। তখন সূর্যের আলোই পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারছিল না। যার ফলে প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়। মেক্সিকোর চিকজুলুবে থাকা বিশাল বিশাল খাদগুলো দেখলে এই ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা আঁচ করা যায়।

 

কিন্তু ডেভোনিয়ান কালে এ ধরনের কোনো ধ্বংসযজ্ঞের আলামত এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। যৌক্তিকভাবেই তাই কোনো উল্কাপিণ্ডের সংশ্লিষ্টতার কথা হিসাবের বাইরেই রাখতে হয়। হয়তো তখনকার পরিবেশের কোনো বিপর্যয়ের জন্যই ডেভোনিয়ান কালের বিলুপ্তি হয়েছিল।

 

সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থমাস অ্যালজিও এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। তার মতে, ডেভোনিয়ান কালে সাগরদেশের প্রাণীগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়া উদ্ভিদরাজির কারণে। বড় বড় বৃক্ষ, ফার্ন থেকে শুরু করে এমনকি ফুলের গাছও পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল এ সময়ে। যদিও মূলহীন প্রাচীন উদ্ভিদরাজি ডেভোনিয়ান কালের অনেক আগেই বিবর্তিত হয়েছিল।

 

স্থলভাগে এ সমস্ত শিকড়ওয়ালা গাছের অনেক প্রভাব ছিল। ভূপৃষ্ঠের বেশ গভীরেই এদের শিকড়গুলো ঢুকে পড়ত। এতে করে পাথর ভেঙে যেত আর মাটির তৈরি হতো। এই পাথর ভাঙার সময় গাছেরা পুষ্টি উপাদান আর খনিজ পদার্থ নিঃসরণ করত। এগুলো অন্যান্য গাছের উপকারেও আসত, আবার পানিতে ধুয়ে নদী আর সাগরেও মিশে যেত।  ঠিক তখনি সাগরের জীবনগুলো বিপর্যায়ের মুখে পড়ে।

 

স্থলভাগে এই গাছগুলোর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমতে থাকে। গ্রিনহাউস গ্যাস নামে পরিচিত কার্বন ডাই-অক্সাইড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যের  তাপকে  ধরে রাখে। ক্রমবর্ধমান এই বৃক্ষরাজির বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একেবারেই হিম শীতল হয়ে পড়েছিল। তাপমাত্রা যখন একেবারেই কমে গেল তখন হিমবাহ তৈরি হতে লাগল। হিমবাহগুলো ডাঙায় পানি আটকে রেখে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে আরো নিচে নামিয়ে আনে, যা কিনা শেষে সমুদ্রদেশের প্রাণীগুলোর জীবনযাত্রায় ভয়ানক প্রভাব ফেলে।

 

যখন পৃথিবীতে এত সব পরিবর্তন একসঙ্গে শুরু হলো তখন অনেক প্রাণীই জীবন টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে লাগল।

 

প্রকৃতপক্ষে এই পরিবর্তনগুলোর সব একসঙ্গে ঘটেনি, যেমনটি এই গণ-বিলুপ্তি একদিনে ঘটেনি।পুরো প্রক্রিয়াটি প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছর ধরে চলেছে।

 

কিছু প্রজাতি হয়তো টিকে থাকতে না পেরে  তখন  বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল আর এরা যাদের প্রতিবেলার খাবার ছিল তারাও আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। অনেক বছর ধরে চলা ধীর প্রক্রিয়া ছিল এটা।

 

যেকোনো সাধারণ সময়ের চেয়ে এই বিশৃঙ্খল সময়ে যেকোনো ধরনের দুর্যোগই বেশি ভয়াবহ হওয়ার কথা ছিল। অ্যালজিওর মতে, তখন কোনো ভয়াবহ অগ্ন্যুপাতের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তিনি মনে করেন, ওই রকম প্রতিকূল পরিবর্তিত পরিবেশে এ ধরনের যেকোনো দুর্যোগই বিলুপ্তায়নের এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করত।

 

এগুলো আসলেই সব অনুমান বৈকি আর কিছুই নয়। আসলেই কি স্থলভাগে কেবল কিছু বৃক্ষের আবির্ভাবের ফলে সমস্ত সাগরদেশের প্রাণীদের জীবনযাত্রায় এতটা পরিবর্তন এসেছিল?

 

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার ওয়ার্ড চমকপ্রদ কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, এই জীবগুলো নিজেদের বিলুপ্তির জন্য নিজেরাই অনেকাংশে দায়ী। ডেভোনিয়ান কালের প্রাণীদের এই বিলুপ্তি ওয়ার্ডের মেডেয়া হাইপোথিসিসের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মিলে যায়। এই হাইপোথিসিস অনুযায়ী প্রাণমাত্রই আত্মবিধ্বংসী।

 

ওয়ার্ডের ভাষায় তখন এই স্থলভাগের গাছগুলো বলতে গেলে রীতিমতো একটা টিকে থাকার যুদ্ধ জিততে চলেছিল। এই বৃক্ষরাজির শিকড়গুলোর জন্য শুরু হওয়া অদৃষ্টপূর্ব ঘটনাগুলোই প্রাণিজগতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার তৈরি করে।

 

তার মতে, এ রকম ঘটনা পৃথিবীতে আগেও ঘটেছিল। প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী ঠান্ডায় জমে গিয়ে বরফের বলের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল। তখনকার জীবগুলোও সম্ভবত বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড  টেনে নিয়ে এ রকম পরিবেশ তৈরি হওয়াতে ভূমিকা রেখেছিল।

 

গ্রাইসের মতে, কেবল ডেভোনিয়ানরাই এরকম পুষ্টি উপাদানজনিত বিলুপ্তির শিকার না, কমপক্ষে আর দুটো গণ-বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছিল এই পুষ্টি উপাদানের কারণে। এদের একটি ছিল ২৫০ মিলিয়ন বছর আগেকার গ্রেট ডায়িং আর আরেকটি হলো ২০১ মিলিয়ন বছর আগেকার ট্রাইয়াসিক বিলুপ্তি।

 

আপাতদৃষ্টিতে ওয়ার্ডের এই আত্মবিধ্বংসী তত্ত্বটি খুব ভয়ানক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ডেভোনিয়ানদের বিলুপ্তি একদিক থেকে খুব ভালো একটি ঘটনা ছিল। ডেভোনিয়ান কালের পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নতুন কিছু প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। প্রায় ৩৪০ মিলিয়ন বছর আগে অ্যাঞ্জেল ফিশের আবির্ভাব ঘটে। এ মাছের দেহকাঠামো ছিল একেবারেই ভিন্ন।

 

আর ঠিক সে সময়ই ডাঙায় প্রথম বৃহৎ আকারের প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। মাছগুলো নিজেদের পাখনাকে বিবর্তনের ধারায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পরিণত করে ডাঙায় বসবাসের জন্য উঠে আসে।

 

সভ্যতার বুননে খুব বেশি সফল বলে মানবজাতি অন্যান্য প্রাণীদের একেবারেই কোণঠাসা করে ফেলেছে। যেকোনো ধরনের সামান্য হেরফের হলেই আমরা ছিটকে পড়ে যাব পৃথিবীর হিসাব থেকে। ডেভোনিয়ানদের বিলুপ্তি এটাই ইঙ্গিত করে যে, এ ঘটনা আগেও ঘটেছিল এবং তা আবারও ঘটতে পারে!

 

লেখক : শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ জুলাই ২০১৫/রাসেল পারভেজ/এএন      

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়