‘ঢাকা শহরে মানুষ বোধহয় মানুষের প্রয়োজনে আসে না’
রণজিৎ সরকার || রাইজিংবিডি.কম
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার
রণজিৎ সরকার : কয়েকদিন হলো আমার মন খারাপ। ভীষণ মন খারাপ। কারণ নিকট দুজন আত্মীয় মারা গেছে আমার। মঙ্গলবার ভারতী পিসির স্বামী নিপুবরণ রায় মারা গেছেন। অন্যজন হলো সাবিত্রী মাসির ১৪ বছরে ছেলে সোহাগ ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে শুক্রবারে মারা গেছে।
তাদের জন্যই আমার মন খারাপ। আমি ঢাকায় থাকি, তাই তাদের শেষ দেখা দেখতে পারলাম না। যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে সেজন্য আমার মন আরো বেশি খারাপ। বার বার মনে পড়ছে তাদের স্মৃতি।
মন খারাপ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। যাব মিরপুর এক নম্বরের। রিকশা না পেয়ে নতুন বাজার থেকে হেঁটে যাচ্ছি বাঙলা কলেজের দিকে।
রাস্তায় হঠাৎ দেখা আমাদের ফ্ল্যাটের রুবেল ভাইয়ের সঙ্গে। রুবেল ভাই আমাকে দেখে বললেন, ‘দাদা, মন খারাপ করে কোথায় যান?’
বললাম, মিরপুর এক নম্বরে আমার এলাকার এক ভাই থাকেন। তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
রুবেল ভাই বললেন, ‘আচ্ছা, যান তাহলে।’
ধীরে ধীরে বললাম, ভাই, যাই, পরে কথা হবে।
‘সাবধানে যাবেন।’
ধন্যবাদ, ভাই।
হেঁটে যেতে লাগলাম। একটু পর রাস্তা পর হলাম। বাঙলা কলেজের গেটের একটু দূর ওভারব্রিজের পাশে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। মিরপুর এক নম্বর যাওয়ার জন্য। অপেক্ষা করছি গাড়ির। এর মধ্যে কে যেন আমার ডান হাত ধরল। অবাক হলাম। হঠাৎ, কে আমার হাত ধরল। সঙ্গে সঙ্গে তাকালাম, দেখি এক বৃদ্ধা। আমি কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা বললেন, ‘বাপজান, আমি রাস্তা পার হব। কয়েকজনকে বললাম, একটু রাস্তা পার করে দিতে। কিন্তু কেউ দিলো না। কেউ আবার বলে ওভারব্রিজ দিয়ে পার হয়ে যান। আমি কি, এই বয়সে ওভারব্রিজের উপর উঠতে পারি।’
ভাবলাম, উপকার করতে গিয়ে আবার বিপদে হবে না তো! বৃদ্ধাটার দিকে ভালো করে তাকালাম, সন্দেহ হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না তার মাঝে। তারপর বৃদ্ধাটাকে বললাম, হাত ছেড়ে দেন।
বৃদ্ধাটা মাথাটা নিচু করে বললেন, ‘হাত ছাড়ব না। হাত ছাড়লে আমাকে পার না করে দিয়ে যদি তুমি চলে যাও। আমাকে রাস্তা পার করে দাও। রাস্তা পার না হওয়া পর্যন্ত হাত ছাড়ব না আমি।’
বৃদ্ধাটার অন্য হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগের দিকে বেশ কয়েক বার আমি তাকালাম। বৃদ্ধাটা বুঝতে পারলেন। তার প্রতি আমার সন্দেহ হচ্ছে।
বৃদ্ধাটা বললেন, ‘বাপজান, আমাকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। আমাকে শুধু একটু রাস্তা পার করে দাও।’
সাহস করে বললাম, ‘আপনার প্রতি সন্দেহ হবে কেন?’
‘তাহলে পার করে দাও।’
আর কোনো কথা না বলে। রাস্তার এদিক-ওদিক তাকালাম। দেখি রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। বৃদ্ধাটার হাত শক্ত করে ধরে বললাম, চলেন।
বৃদ্ধাটা আমার দিকে তাকালেন। তাকানোর মধ্যে একটা স্বস্তিবোধ বুঝতে পারলাম। তারপর খুব সাবধানে বৃদ্ধাটা নিয়ে রাস্তা পার হলাম।
বৃদ্ধাটা স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন , ‘ঢাকা শহরে মানুষ মানুষকে বেশি অবিশ্বাস করে। আর সেজন্য হয়তো, ঢাকা শহরে মানুষ বোধহয় মানুষের প্রয়োজনে আসে না।’
বৃদ্ধার কথাটা শুনে অবাক হলাম। ভাবলাম, সত্যি কথাই তো তিনি বলেছেন। ঢাকা শহরের মানুষ মানুষকে বিপদের ভয়ে অবিশ্বাস করে। আর সেজন্যই উপকার করতে চায় না। উপকার করতে গিয়ে অনেকেই বিপদের মুখোমুখী হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ মানুষের বিপদের দিনে প্রয়োজনের সময় আসে না।
বৃদ্ধাটা বসে বললেন, ‘বাপজান, কী ভাবো? তাড়া থাকলে চলে যেতে পারো। আমি এখন একা যেতে পারব।’
বৃদ্ধাটার কথা শোনার পর নিজেকে বিপদ মুক্ত হলাম, তারপর বললাম, এখন আপনি যেতে পারবেন তো?
‘হ্যাঁ, যেতে পারব। আমার আর কোন সমস্যা হবে না।’
বললাম, আপনি কোথায় যাবেন?
বৃদ্ধাটা বললেন, ‘ছাপড়া মসজিদ।’
পাশে একটা রিকশা ছিল। রিকশাচালককে ডাক দিয়ে কাছে নিয়ে এলাম। তারপর বৃদ্ধাকে রিকশাতে উঠালাম।
বৃদ্ধা অবাক হলেন। রিকশাচালকে ২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে বললাম, ছাপড়া মসজিদে নামিয়ে দেবেন।
রিকশা সামনের দিকে যেতে লাগল। বৃদ্ধাটা রিকশা উপর থেকে পেছনে তাকালেন। আমিও তাকালাম।
কিছুক্ষুণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশা পেলাম। রিকশায় উঠে মিরপুর এক নম্বরের দিকে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম, ঢাকা শহরে মানুষের বিপদে মানুষের প্রয়োজনের কথা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ আগস্ট২০১৫/রণজিৎ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন