ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে’

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১২ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে’

কবি কামিনী রায়

শাহ মতিন টিপু : ‘করিতে পারি না কাজ, সদা ভয়, সদা লাজ,/ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,/ পাছে লোকে কিছু বলে।/আড়ালে আড়ালে থাকি, নীরবে আপনা ঢাকি/ সম্মুখ চরণ নাহি চলে,/ পাছে লোকে কিছু বলে।’ ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ শিরোনামের কবিতাটির এই কয়টি চরণই তাকে চিনিয়ে দেয়, তিনি কবি কামিনী রায়।

তার আরেকটি কবিতার লাইন এ রকম- ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলই দাও/ তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও।/ আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’

‘সুখ’ আরো একটি কবিতা এ রকম-  ‘নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ? এ ধরা কি শুধু বিষাদময়। যাতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে, কেবলি কি নর জনম লয়।’ এমনই অসংখ্য কবিতা লিখেছেন তিনি।

অবাক করা তথ্য হচ্ছে, তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী স্নাতক ডিগ্রিধারী। তিনি একসময় যে ছদ্মনামে লিখতেন তা-ও মজার ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’। কামিনী রায়ের জন্ম ১২ অক্টোবর ১৮৬৪। জন্ম বরিশালে বাসন্ডা গ্রামে।

১৮৮০ সালে কলকাতা বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) ও ১৮৮৩ সালে এফএ বা ফার্স্ট আর্টস (উচ্চমাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বেথুন কলেজ থেকেই ১৮৮৬ সালে ভারতের প্রথম নারী হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষয়িত্রীর পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি ওই কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেন।

যে যুগে মেয়েদের শিক্ষাও বিরল ঘটনা ছিল, সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার অনেক প্রবন্ধেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্য ছিলেন।

শৈশবে তার পিতামহ তাকে কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন। এভাবেই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা করেন ও কবিত্ব-শক্তির স্ফুরণ ঘটান। তার জননীও তাকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতেন। ১৫ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে। এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রকাশিত হয়নি।

তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- আলো ও ছায়া (১৮৮৯), নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪), অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবন পথে (১৯৩০), অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত `মহাশ্বেতা` ও `পুণ্ডরীক` তার দুটি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এ ছাড়া ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য ‘গুঞ্জন’ নামে কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেন।

কামিনী রায় সব সময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। ১৯২৩ সালে তিনি বরিশাল সফরের সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে বলেন।

তার কবিতা পড়ে বিমোহিত হয়ে তাকে বিয়ে করেছিলেন কেদারনাথ রায়। ১৯০৯ সালে কামিনী রায়ের স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিল। সেই শোক ও দুঃখ তার ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা তার কবিতায় প্রকাশ পায়।

শেষ জীবনে কবির স্বামী-সন্তান হারিয়ে একা হয়ে পড়েন কবি কামিনী রায়। ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে বাস করতে থাকেন। কামিনী রায় যে এলাকায় থাকতেন তার নাম হাজারীবাগ। এখানেই কবির জীবনাবসান ঘটে। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ সালে কবি কামিনী রায় মৃত্যুবরণ করেন।

সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘জগত্তারিণী’ পদকে সম্মানিত করে।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ অক্টোবর ২০১৫/টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়