মাহবুব উল আলম চৌধুরী : কবি ও ভাষাসৈনিক স্মরণে
সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী
সাইফ বরকতুল্লাহ : ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’- এটি একুশের প্রথম কবিতা। এ কবিতার স্রষ্টা মাহবুব উল আলম চৌধুরী। গতকাল ৭ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন চলে গেল যেন অনেকটা নীরবেই। অথচ সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সমাজ সংস্কারে তিনি আমৃত্যু সরব ছিলেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যত আন্দোলন, সংগ্রাম হয়েছে এর প্রতিটিতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন সুতীব্র উচ্চারণে।
চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের গহিরা গ্রামে ১৯২৭ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রতিবাদী মানসিকতা শিক্ষাজীবনের একটি ঘটনাতেই টের পাওয়া যায়। ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র তিনি। মাসে ১৬ টাকা বৃত্তি পেতেন। একদিন তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর কলেজ পরিদর্শনে এসে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কটু মন্তব্য করে আরবি হরফে শিক্ষার পক্ষে মত ব্যক্ত করলে, মাহবুব উল আলম চৌধুরী তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করেন। এ ঘটনা সে সময় বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
শিক্ষাজীবনেই মাহবুব উল আলম চৌধুরী সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন। ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে যোগদান করেন ছাত্র ফেডারেশনে। সে বছর চট্টগ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে কলকাতা থেকে আসেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ভবানী সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। সম্মেলনে তিনি কর্মী হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ওই বছর তিনি চট্টগ্রাম প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জন্মজয়ন্তীর অন্যতম সংগঠকও ছিলেন তিনি।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী আমৃত্যু প্রগতি ও মুক্তির সাধনা করেছেন। যার মাধ্যমে অর্জিত হয় সাম্য ও চিরায়ত মানবাধিকার। বামপন্থী আন্দোলন ও সংগ্রামের একনিষ্ঠ অনুসারী ও নীরব সংগঠক হিসেবে নানা বাধাবিঘ্ন ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ব্রত সাধনে অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। তিনি বহু কবিতা, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম মর্যাদাবান মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সীমান্ত’ (১৯৪৭-১৯৫২)। সত্তর দশকে সম্পাদনা করেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ (১৯৭২-১৯৮২)। দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে একই মেলবন্ধনে মিলিয়েছিলেন।
আবেগধারা’ তাঁর ছেলেবেলায় লিখিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়া চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকে ‘ইস্পাত’ এবং ‘অঙ্গীকার’ নামে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে ‘বিষের নেশা’ নামে একটি উপন্যাসও লিখেছেন। ১৯৪৭ সালে লিখিত তাঁর পুস্তিকা ‘বিপ্লব তদানিন্তন’ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটিও পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। ৫০-এর দশকের প্রথম দিকে তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় গঠিত হয় প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। সীমান্ত পত্রিকায় তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের (১৯৫০) ডাকে আণবিক বোমা নিষিদ্ধিকরণের দাবিতে ব্যাপক প্রচার চালান। স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামেও বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখা স্থাপন করেন। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ওই পরিষদের সম্পাদক ছিলেন।
১৯৫১ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে জড়িত করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। সংবর্ধিত হয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। ২০০৬ সালে জাতীয়ভাবে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।
আলোকপিয়াসী মাবুব উল আলম চৌধুরী এই পৃথিবীর আলো-আঁধারের জীবনে আলোকেই নিরন্তর খুঁজে ফিরেছেন। সন্ধান করেছেন মহামুক্তির। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজও দ্রোহে উচ্চারিত হয় তাঁর কবিতার অমর পঙ্ক্তি :
‘যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসি দাবি করছি
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৪/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম