ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

১৫ আগস্টের শহীদ আরজু মণির স্মৃতিকথা

ড. জেবউননেছা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ১৫ আগস্ট ২০২২   আপডেট: ১২:১১, ৯ মার্চ ২০২৩
১৫ আগস্টের শহীদ আরজু মণির স্মৃতিকথা

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর প্রস্তুত শিরোনামে কবিতায় প্রথম স্তবকে লিখেছিলেন, কালো মৃত্যুরা ডেকেছে আজকে স্বয়ম্ভরায়/নানাদিকে নানা হাতছানি দেখি বিপুল ধরায়/ভীত মন খোঁজে সহজ পন্থা, নিষ্ঠুর চোখ/তাই বিষাক্ত আস্বাদময় এ মর্তলোক/কেবলি এখানে মনের দ্বন্দ্ব আগুণ ছড়ায়’- কবির কাব্যে ফুটে উঠেছে পৃথিবীর চিরাচরিত রূপ।

এমনই এক মনের আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন এক সরলা নারী। যিনি সাধারণ আট দশজন নারীর মতই সংসার ধর্ম করতে চেয়েছিলেন। সংসারের শুরুটা হয়েছিল এক সুন্দরের আয়োজনে। কিন্তু জীবনের প্রদীপ নিভে গিয়েছে জীবনের আলো না ফুটতেই। তেমনি এক নারী যার নাম বেগম সামসুন নেছা আরজু সেরনিয়াবাত। যিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ মার্চ বাংলা ১৩৫৩ সনের ১লা চৈত্র অবিভক্ত ভারতের কলকাতার ১৪ নম্বর স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বরিশালের আগৈলঝড়া থানার সেরাল গ্রামে। নিজ জেলা শহরেই তার বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কৃষক নেতা শহীদ অ্যাডভোকেট আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেজো বোন আমেনা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। শহীদ আরজু মণি ১৯৬৪ সালে বরিশাল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হন এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাবার কাছেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। রাজনৈতিক সচেতন আরজু মণি ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং বরিশাল সরকারি  মহিলা কলেজ ছাত্রী সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। 

আরো পড়ুন:

তাঁর পিতা সময় পেলেই রাজনীতি সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিষয়ে আলাপ করতেন। পিতার কাছেই তার রাজনীতির হাতেখড়ি। বাবার সাথে প্রভাতফেরিতে যেতেন। বাবার অনুপ্রেরণায় আইয়ুব শাহীর কালো দশকে তিনি দুঃসাহসী নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।

তিনি ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর বড় বোন আছিয়া বেগমের ছেলে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক এবং শহীদ শেখ ফজলুল হক মণির সাথে ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

সংসার জীবনে স্বামী শেখ মণির রাজনৈতিক জীবনের সাথেও তিনি গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। একদিকে সংসারের সব দায়িত্ব অন্যদিকে স্বামীর সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবকিছুই তিনি সামাল দিতেন। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধে ও তিনি স্বামীর পাশে থেকেই তাকে সব রকম উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়েছেন। পড়াশুনার প্রতি ছিল তার গভীর আগ্রহ। দেশ স্বাধীন হবার পর সংসারের দায়িত্ব, রাজনৈতিক ব্যস্ততা, পরপর দুইটি সন্তানকে লালন পালন করা। এত কিছুর মধ্যে ও তাঁর প্রবল ইচ্ছে ছিল কিভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা যায়। তাই বিলম্ব হলেও সকল প্রতিকূল অবস্থাকে অতিক্রম করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এমএ ভর্তি হন এবং পরবর্তীকালে, ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল দেখে যেতে পারেননি।

তাঁর বোন হুরুন্নেসা মঞ্জুর স্মৃতিতে আরজু সেরনিয়াবাত এখনো জীবন্ত। তিনি বলেন, ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ সেদিনের কথাটি ভুলতে পারেন না। সেদিনই ছিল তার সাথে শেষ দেখা। তিনি তার বোনের মুখটা মলিন দেখে জানতে চেয়েছিলেন, কি হয়েছে? উত্তর দিয়েছিলেন, শরীরটা খারাপ লাগছে। তিনি খুব সহজ সরল ছিলেন। বিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি আসা যাওয়ার পথ প্রায়ই ভুলে যেতেন। তাই স্কুলের আয়া জ্ঞানদা সে তাকে নিয়ে আসত আবার নিয়ে যেতো। একবার এক রিকশাওয়ালাকে ডেকে বলছিলেন, এই যাবে কালিবাড়ী? রিকশাওয়ালা বলেছিলেন যাব, তারপর জানতে চেয়েছিলেন, কত টাকা। রিকশাওয়ালা উত্তর দিয়েছিলেন ১২ আনা। সে প্রতি উত্তরে বলেছিলেন, ১ টাকায় গেলে যাও, না গেলে না যাও। এতটাই সহজ সরল ছিলেন যে, ১২ আনার চেয়ে এক টাকার মূল্য হিসেব করতেন না। বাবাকে কলেজে যাবার সময় বলতেন, বাবা আমার জন্য দুই লোকমা ভাত মেখে রেখো। আমি এসে খাব। বাবা কোর্টে যাবার সময় বেগুন ভাজা, আলু ভর্তা এবং ঘি দিয়ে ভাত মেখে রাখতেন। একদিন তিনি দেখেন আরজু মণি কাথাঁ মুড়িয়ে শুয়ে আছেন। তখন বোন জিজ্ঞেস করেন, কাঁথামোড়া দিয়ে শুয়ে আছিস কেন রে? আরজুমণি উত্তর দেন তার কাজের লোক কি যেন ঘর থেকে নিয়ে যাচ্ছে। সে দেখে ফেললে কাজের লোক লজ্জা পাবে। তাঁর প্রিয় বন্ধু ছিলেন, জয়শ্রী, খুশী চক্রবর্তী, জাকিয়া ওয়াহাব এবং ফরিদা আক্তার। তার বাবা চেয়েছিলেন, তিনি স্নাতকোত্তর পাশ করবেন। জানতে চেয়েছিলেন কবে তারপর তিনি উত্তরে বলছিলেন, পরশ তাপস আগে বড় হউক তারপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করব। তিনি ঠিকই ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষা ও দিয়েছিলেন। ফলাফল পাবার আগেই তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ বলেন, আরজু আপা আমাকে খাওয়াতেন, গোসল করাতেন। লেখাপড়া করতে তিনি ভালোবাসতেন। বাবার মতো তিনি ছিলেন। আমার বাবা বড় বোনকে অনেক ভালোবাসতেন। সে ছিল ব্যতিক্রম। একবার পরীক্ষা দিব, তেমন কোন টাকা নেই হাতে আপা আমার বাসায় এসে ২০টা টাকা দিয়েছিলেন। আব্বাতো তেমন একটা হাত খরচ দিতে পারতেন না। আরজু আপাকে ভালোবাসার কারণে তার সন্তান পরশ, তাপসের জন্য বিরাট ভালোবাসা আমার।

তাঁর আর এক বোন হাবিবুন্নেছা শিউলী সেরনিয়াবাতের স্মৃতিতে আরজু মণি এখনো অমলিন। তিনি একটি স্মৃতিচারণ মনে করেন। একবার তার বাবাকে আরজু মণি বলেছিলেন,আব্বা আপনি বলেন, বোবার শত্রু নেই। কিন্তু এখন দেখছি বোবারও শত্রু আছে। তার বোন হামিদা সেরনিয়াবাত বলেন, পরশ তাপসের স্নেহময়ী জননী, বাবা মায়ের প্রতি আদরের আরজু, ভাই বোনদের প্রিয় আরজু আপা ছিলেন, শিশুর মতো সরল, মিতভাষী, নিরহঙ্কার, নিষ্পাপ সৌন্দর্যের প্রতীক এক আদর্শময়ী নারী। কাউকে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলতে পারতেন না। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। অসহায় এতিম ও বৃদ্ধলোকদের দেখলে তিনি খুব ব্যথিত ও বিচলিত হতেন। মাঝে মাঝে শিশুর মতো প্রশ্ন করতেন, বলতেন সব মানুষই তো আল্লাহর সৃষ্টি তবে কেন আল্লাহ ওদের এত কষ্ট কেন? বলতেন, ‘যেসব শিশুদের মা বাবা নেই পৃথিবীতে ওদের মত দুঃখী আর কেউ নেই। ঘাতকের নিষ্ঠুর ছোবলে নিজের দুই শিশু সন্তানকে এতিম করে যাবেন বলেই হয়তো নিজের অজান্তেই এতিমদের প্রতি তার এই গভীর দুঃখবোধ জাগ্রত হয়েছিল।

তাঁর বড় সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙ্গে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলি দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হইচই। আমরা দুই ভাই ভঁয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি, বাবা মা রত্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মা’র পা দুটো বাবার বুকের উপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাচ্ছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন; দেয়ালে কপাল ঠুকছেন। এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচিকে বললেন, ‘ফাতু, আরজুর পা দুটি মণির বুকের উপর থেকে সরাও’। সেলিম কাকা আর চাচি, বাবা-মার পাশে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে মাকে বাচাঁনোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনও কষ্টের চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে উনি যেন, শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোনও ক্ষত আমার মনে নেই। আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম মনে হয় আমরা ভয়েই কাদঁছিলাম, কারণ মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই প্রথম আমার দেখা। এক সাথে অনেকগুলো মৃত্যু। মা’র মনে হয় অনেক কষ্ট ছিল, আমদেরকে ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিলেন তখন গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সাথে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচীকে বললেন, ‘ফাতু (শেখ সেলিম, এমপির সহধর্মিনী) আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’ ঢাকার ধানমন্ডির সড়ক নং ১৩/১ এ নিজ বাসভবনের সিঁড়িতে ঘাতকের গুলিতে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আরজু বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে  তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আরজু মণির কথা রেখেছেন তার স্বজনেরা। দুই সন্তানকে দেখে রেখেছেন এবং তারা মানুষের মত মানুষ হয়েছেন। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়ত তিনি হতে পারতেন একজন নারী নেত্রী, সমাজসেবিকা। তিনি একজন দানশীল নারী ছিলেন, ছিলেন মৃদুভাষী এবং মমতাময়ী। তিনি দুঃস্থ অসহায় এতিম ও বয়স্ক লোকদের দেখলে  ব্যথিত ও বিচলিত হয়ে পড়তেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আরজু নামের অর্থ ‘বাসনা’। একজন বাঙালি নারী হিসেবে তাঁর বাসনা ছিল আর আট দশজন নারীর মত সংসারধর্ম পালন করবেন, দেশের সেবা করবেন এবং দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে সেই ভয়াল রাতে ঘাতকরা একই সাথে পাঁচ বছর বয়সী পুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ (বর্তমানে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান) এবং  চার বছর বয়সী পুত্র ব্যারিষ্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, (বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র) কে রেখে শহীদ হন। রাজধানী ঢাকার বনানী গোরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের সাথে জীবনের সব বাসনা বিসর্জন দিয়ে শহীদ বেগম সামসুন নেছা আরজু সেরনিয়াবাত নীরবে শুয়ে আছেন। আরজু মণির প্রিয় গানটি তাঁর বড় সন্তান এখনো খুঁজে বেড়ায়-‘পাখি তুমি লক্ষী আমায় মায়ের কাছে নিয়ে যাও/ও তোতা পাখিরে শেকল খূলে উড়িয়ে দিবো/মাকে যদি এনে দাও, মাকে যদি এনে দাও।’ 

আজ এই শোকের দিনে শহীদ আরজু সেরনিয়াবাতকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

তথ্যসূত্র:
১. শহীদ আরজু সেরনিয়াবাতের বোন হুরুন্নেসা মঞ্জু, হামিদা সেরনিয়াবাত এবং হাবিবুন্নেছা শিউলীর সাক্ষাৎকার, ১০.০৯.২০২১
২. শহীদ আরজু সেরনিয়াবাতের ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহর সাক্ষাৎকার, ০৪.০৯.২০২১
৩. চেতনায় বঙ্গবন্ধু (২০২১) নির্বাসনের দিনগুলি, শেখ ফজলে শামস পরশ, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। 

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

/সাইফ/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়