ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আমি এবং হ‌ুমায়ূন আহমেদ

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০০, ১২ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:১০, ১২ নভেম্বর ২০২০
আমি এবং হ‌ুমায়ূন আহমেদ

একদিন আমাদের কুমিল্লার ‘যন্ত্রণা’ বাড়িতে গিয়ে হাজির তিনি। সঙ্গে বোন, বোনের মেয়ে, নিজের দুই কন্যা নোভা,  বিপাশা এবং দু’জন প্রকাশক। ঘণ্টা দু’য়েক ছিলেন। তারপর আবার ঢাকায়। সেটা ১৯৯৩ সালের কথা। এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা হয় আরো অনেকবার। ধীরে ধীরে মানুষটাকে ভালো লাগতে থাকে আমার।

মানুষকে ভালোবাসা, আপন করে নেওয়া, আনন্দ দেওয়া আর বিভ্রান্ত করার ঈশ্বরপ্রদত্ত একটা ক্ষমতা ছিল তাঁর।  যে কোনো গল্প বা আড্ডার আসরে সবসময় তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন মধ্যমণি। সারাক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারেন। তাঁর ‘সেন্স অব হিউমার’ এত ভালো যে, কাউকে কখনো বিব্রত হতে হয়নি তাঁর কারণে। রসিকতা কাকে বলে, কত প্রকার সেটা যারা তাঁর সঙ্গে মেশেননি, তারা জানেন না।

৯৪ সালের ১৩ নভেম্বর তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করেন আমাকে। সন্ধ্যার পরপরই যেতে বলেন। এক তোড়া ফুল কিনে তাঁর বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। দারোয়ান খুব বেশি পাত্তা দেয় না আমাকে। নিচ থেকে ইন্টারকমে তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয় যে, আমি নিমন্ত্রিত অতিথি। তারপর যেতে বলে। তাঁর বাসা ছিল আট তলায়। লিফটে উঠতে যাব, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়! দারোয়ান বললো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে। হেঁটেই আট তলায় উঠি। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আট তলায় উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে না? বসতে বললেন। রুমে তেমন কোনো আসবাবপত্র ছিল না। একটা বুক সেলফ, একটা ক্যাসেট প্লেয়ার, অসংখ্য ক্যাসেট আর বেশ ক’টি ফুলের তোড়া। দেখলাম, আমার আগে আসা বাকীরা নিচে বসে আছেন, কার্পেটে।  আমিও বসলাম।

সেদিন, সেখানে পরিচয় হয় আসাদুজ্জামান নূর, অন্যপ্রকাশের মাজহার ভাই, সময়ের ফরিদ ভাই, সূবর্ণ'র জাহাঙ্গীর ভাই, মাওলার মাহমুদ ভাই, প্রতীক প্রকাশনীর আলমগীর ভাই, অভিনেতা সালেহ আহমেদ, অভিনেতা মোজাম্মেল স্যারসহ অনেকের সঙ্গে। আমিই মোটামুটি কনিষ্ঠ মানুষ ছিলাম সে আড্ডায়। শিল্প, সংস্কৃতি, গান, সিনেমা, হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, বইমেলা... কোনোটাই বাদ ছিলো না সে আড্ডায়। আড্ডার এক ফাঁকে কে যেনো জানতে চাইলেন, এত উপরে ফ্ল্যাট নিয়েছেন কেন? তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে- মশারা নাকি পাখায় ভর করে আট তলা পর্যন্ত উঠতে পারে না, সেজন্য। এও বললেন, দেখেন আমার বাসায় কোনো মশা নাই! সত্যিই ছিলো না মশা। এটা আমার কাছে মিসির আলীর যুক্তি মনে হয়েছে। সেদিনের সে আড্ডা চলেছিল অনেক রাত পর্যন্ত।

আবারও তাঁর সঙ্গে দেখা তাঁরই বাসায়। সেটা ৯৫ সালের জানুয়ারিতে। তখনো তিনি এলিফেন্ট রোডেই থাকেন। তাঁকে বললাম, এবারের একুশের বইমেলায় আমরা একটা স্টল নেব। সেখানে আমরা শুধু আপনার লেখা বই রাখবো। অন্য সব কটি প্রকাশনীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আপনি রাজি হলে তাদের প্রকাশনী থেকে বের হওয়া আপনার লেখা সব বই তারা আমাদের দেবেন। এটি হবে আপনার লেখা সব বই পাওয়া যাবার একমাত্র দোকান। দোকানের নামও ঠিক করে ফেলেছি- ‘কোথাও কেউ নেই’।

কিছু না বলে তিনি গম্ভীরভাবে শুনলেন। তারপর একটু হাসি মুখে জানতে চাইলেন, তার মানে তোমরা আমার বইয়ের একক স্টল দিচ্ছো? এটা ভালো যে, পাঠক এক দোকানে আমার লেখা সব বই পাবে।

মেলা শুরু হলো। সব প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখা প্রতিটি বইয়ের ১০ কপি সংগ্রহ করে শুরু করলাম আমাদের কোথাও কেউ নেই স্টল। পাঠক এসে টুকটাক বই কিনে নিয়ে যেত। এর মধ্যে মেলায় আগত সব পাঠক জেনে গেছেন- আমাদের স্টলে গেলে তাঁর লেখা সব বই পাওয়া যাবে। ফলে দিনদিন আমাদের দোকানে ভিড় বাড়তেই লাগলো। ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত দোকানের সামনে বাঁশ পুঁতে, তাতে মোটা দড়ি পেঁচিয়ে পাঠকদের সামলেছিলাম। এর মধ্যে দুদিন পুলিশ দিয়েও লোকজন ঠেকাতে হয়েছে...। তিনি ছিলেন এমনই একজন লেখক। যার বই পাগলের মতো কিনতো আর পড়তো পাঠক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আর আসবেন কিনা, জানি না!

তাঁর কারণে আমরা অনেকে সেন্টমার্টিন চিনলাম। তিনি সেখানে এক টুকরো জায়গা কিনে ছোট করে একটা টিনের বাড়ি বানালেন। নাম দিলেন- সমুদ্র বিলাস। ২০০০ সালে একদিন তাঁকে বললাম, সেন্টমার্টিন যাবো। সমুদ্র বিলাসে থাকবো। তিনি রাজি হলেন। তবে কঠিন শর্ত দিয়ে দিলেন। বললেন, পূর্ণিমা দেখে যেতে। রাতে কোনোভাবেই সমুদ্র বিলাসে ঘুমানো যাবে না। সারা রাত সমুদ্রের সামনে বসে পূর্ণিমা দেখতে হবে। এই শর্তে রাজি হলে যাবার সময় যেনো তাঁর কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যাই। কেয়ার টেকারকে লেখা তাঁর সে চিঠি নিয়ে আমরা তিনজন সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। টেকনাফ থেকে ট্রলারে চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু। নাফ নদী পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আর আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ি। মাঝিকে হাতে পায়ে ধরে মিনতি করি, আমাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য। মাঝির দয়া হয়। ট্রলার ঘুরিয়ে আবার নাফ নদীতে নিয়ে আসে। সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য জেলে নৌকা। তার একটাতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে চোখের সামনে দিয়ে দুলতে দুলতে ট্রলার চলে যায় দ্বীপের দিকে। আর আমরা ফিরে আসি টেকনাফ। পরে অনেকবার গেলেও জীবনে প্রথমবার সেন্টমার্টিন না গিয়ে ফিরে এসেছিলাম।

জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে অনেকবার দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। ধানমন্ডির দখিন হাওয়া আর নূহাশ পল্লীতে একসঙ্গে বসে গান শুনেছি। তাঁর বাসায় বছরে একবার মানে ১৩ নভেম্বর যাওয়াটা ছিলো রুটিন। ততদিনে এলিফেন্ট রোড ছেড়ে তিনি ধানমন্ডিতে। ইতোমধ্যে তাঁর পরিবারের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। গুলতেকিন ভাবি, তাঁর বড় মেয়ে নোভা, মেজো মেয়ে শিলা আর ছোট মেয়ে বিপাশা। ছেলে নুহাশ তখন বেশ ছোট। ছোট ভাই আহসান হাবীব (উন্মাদ সম্পাদক), জাফর ইকবাল স্যার, তাঁর বোন, তাঁর মা...।

২০১০ সালে এসে তাঁর সঙ্গে কোনো এক কারণে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়। আমি তখন একটা নাম করা হাসপাতালের জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে। তাঁর মাকে ভর্তি করানো হলো সে হাসপাতালে। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও তাঁর মায়ের চিকিৎসায় কিছু ত্রুটি হয়েছিলো। এই নিয়ে ফোনে তিনি আমার সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করেন। প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন আমাকে। আমি প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে লিখিতভাবে তাঁর কাছে ক্ষমা চাই। তিনি ক্ষমা করেও দেন। কিন্তু তাঁর চার পাশে ঘিরে থাকা তোষামোদকারীরা তাঁকে উসকে দেয় আবার। তিনি রেগে পরের দিন ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় তাঁর মায়ের চিকিৎসা নিয়ে বিশাল একটি লেখা লেখেন। এ লেখা দেখার পর তাঁর প্রতি আমার প্রচণ্ড অভিমান হয়। আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই।

আমার এক বড়বোন। যিনি ছিলেন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু। হাসপাতালের বিষয়, আমার অভিমানের কথা আপা জানতেন। একদিন সে আপার ফোনকলে জানতে পারি- মানুষটার ক্যানসার হয়েছে। আমি যেনো তাঁর প্রতি কোনো ক্ষোভ আর অভিমান না রাখি...। আপা আরও জানালেন, সেদিন রাতেই তাঁকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হবে চিকিৎসার জন্য... তাঁর জন্য দোয়া করতেও বললেন। ফোনের অন্য প্রান্তে আমি চুপ হয়ে যাই।

তাও বেশ কিছুদিন পর কোনো এক বৃহস্পতিবার (১৯ জুলাই ২০১২) রাত এগারোটার দিকে সেই আপা আবারও কল করে জানালেন, স্যার নেই... এর বেশি বলতে পারেননি। দ্রুত টিভির সামনে যাই। টিভির স্ক্রিনে দেখাচ্ছে, হ‌ুমায়ূন আহমেদের অবস্থা সংকটাপন্ন, তাঁর জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন পরিবারের লোকজন... এভাবে দশ-পনেরো মিনিট গেলো। একসময় টিভির স্ক্রলের লেখাটা পাল্টে গেলো- প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদ আর নেই...।

কথাসাহিত্য, শিক্ষকতা, নাটক লেখা, গান, চলচ্চিত্র পরিচালনা- যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। বাংলাদেশের পাঠকদের বই পড়ার নেশা ধরিয়েছেন তিনি। তার সৃষ্টি চরিত্র হিমু আর মিসির আলি।  হিমু পুরোপুরি বাউণ্ডুলে। চারপাশের মানুষদের বিভ্রান্ত করা, রাত বিরাতে শহরময় ঘুরে বেড়ানো, জীবন চলার জন্য কোনো পেশাকেই বেছে না নেওয়া। আর মিসির আলি একদম উল্টো টাইপের মানুষ। যার জীবন চলে পুরোপুরি লজিকে। সম্পূর্ণ কাল্পনিক হলেও হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এরকম আরো কয়েকটি নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। থাকবে বাংলা সাহিত্যে। এর মাঝে রয়েছে শুভ্র, রুপা, পরী, বদি, মুনা। যারা ঘুরে-ফিরেই তাঁর লেখা গল্প উপন্যাসে ঠাঁই পেয়েছে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি আরেকটি বিখ্যাত চরিত্র বাকের ভাই। যার কথা না বললেই নয়। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাই এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, মিথ্যে খুনের দায়ে তার যখন ফাঁসির আদেশ হয় সে ফাঁসি বন্ধের দাবিতে সারাদেশে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। উল্লেখ্য, বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। কাল্পনিক একটা চরিত্রের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে মিছিল হওয়া, এমন ঘটনা আর কোনোদিন বাংলাদেশে ঘটবে না। তাঁর সৃষ্ট অনেকগুলো চরিত্র, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, গান যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মনে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মেছিলেন বিরল গুণের অধিকারী এ মানুষটি। শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক, সাহিত্যিক। যেখানে আছেন, ভালো থাকুন। আপনার আত্মার চিরশান্তি হোক।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়