ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ১০ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১০:৩৭, ১০ জানুয়ারি ২০২১
দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশে ফেরেন।  বেলা ১টা ৪১ মিনিটে জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন।

বঙ্গবন্ধু এইদিন লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফেরেন।  ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেট বিমানে শেখ সাহেব সকাল ৮টা বেজে ২ মিনিটে পালাম বিমানবন্দরে নামেন। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেওয়া হয়। যে সংবর্ধনা আজো অবিস্মরণীয় বিষয়। 

পরদিন ভারতের বাংলা ইংরেজি পত্রিকার পাতাজুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ ও প্রতিবেদন। 

বলা হয়, দিল্লির সংবর্ধনার আয়োজন ছিল আবেগ উচ্ছ্বাসের পরিপূর্ণতায় ভরপুর।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে নয়াদিল্লিতে এসে পৌঁছলেন।  সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।  দিল্লিতে এমন সংবর্ধনা বঙ্গবন্ধুর পূর্বে আর কেউ পাননি বলেও ছিলো ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদপত্রের মত।  

সেদিন ভারতের ‘যুগান্তর’ পত্রিকা লিখেছিলো-

পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগৃহে ৯ মাসের অধিককাল যাপনের পর স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে লন্ডন থেকে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর একটি কমেট বিমানে এখানে এসে পৌঁছুলে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়।  স্বাধীনতার পর গত ২৫ বৎসর বহু রাষ্ট্রপ্রধানকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে, কিন্তু এমনটি আর কখনও দেখা যায়নি।  এ যেন যুদ্ধজয়ের পর স্বদেশ প্রত্যাগত বীরের প্রতি সংবর্ধনা।  অভ্যর্থনার স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতার জন্য আজ দিনটি স্মরণীয়।… ২১ বার তোপধ্বনি করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়।  মুজিব বিমান থেকে বেরিয়ে এলে সমবেত জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।  শেখ মুজিবের বিমানটি যখন অবতরণ করে তখন বিমানঘাঁটিতে ভারতের ত্রিবর্ণরক্ষিত জাতীয় পতাকা ও বাংলাদেশের সবুজ পটভূমিকায় লাল ও সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা উড়ছিল।  সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে দুই দেশের জাতীয় সংগীত ‘জনগণ মন’ ও ‘সোনার বাংলা’ বাজতে থাকে।  শেখ মুজিবের আগমনের পরে ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর ১৫০ জনের সম্মিলিত গার্ড অব অনার পরিদর্শন করে।  বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’, ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে তার প্রীতিভাষণ শেষ করেন।  কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্যারেড গ্রাউন্ড অভিমুখে যাত্রা করেন।  প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও হাজার হাজার নর-নারী পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে থেকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান।  বিমানঘাঁটি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে প্যারেড গ্রাউন্ডে যখন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিব এসে পৌঁছান তখন মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে থাকে।  বাংলাদেশের স্রষ্টার ভাষণ শোনার জন্য সমবেত হাজার হাজার নর-নারীর কণ্ঠে শুধু ‘মুুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা যায়। বিমানঘাঁটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, মঙ্গোলিয়া, পূর্ব জার্মানি, ভুটানসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।  বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেন।  তিনি ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ বলে তার বক্তৃতা শুরু করতেই জনতা শেখ মুজিবকে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানান। জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তখন বাংলায় তাঁর ভাষণ দেন।  এতে জনসাধারণ তাকে চিৎকার করে অভিনন্দন জানান। শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী চিরস্থায়ী হবে।  বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে পৈশাচিক ও কাপুরুষোচিত অত্যাচার চালিয়েছে ইতিহাসে কোনো শাসকের এরূপ জঘন্য অত্যাচারের কথা জানা যায়নি।  তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “বাংলাদেশ বলতে গেলে এক নারকীয় তা-বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে।… এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।  ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।  পুরুষদের সামনেই মা-বোনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়।  কী অন্যায় করেছিল বাঙালিরা? তারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চেয়েছিল- এটাই ছিল তাদের অন্যায়।  বাঙালিরা বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু তার জবাবে তারা পেয়েছে বুলেট।  বাংলাদেশ এখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ ও ভারত চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।  এই দুটি দেশ চিরদিন শান্তি ও বন্ধুত্বের মধ্যে বসবাস করবে।”

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রতিক্ষণের ধারা বর্ণনা দিয়েছিলেন কলকাতার আকাশবাণী’র দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অসাধারণ আবেগময় কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 

গানটির কথা ছিলো এ রকম-

“বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তুমি আজ

ঘরে ঘরে এত খুশি তাই।

কী ভালো তোমাকে বাসি আমরা, বলো কী করে বোঝাই।

এদেশকে বলো তুমি বলো কেন এত ভালোবাসলে,

সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের এত কাছে কেন আসলে,

এমন আপন আজ বাংলায়… তুমি ছাড়া কেউ আর নাই

বলো, কী করে বোঝাই।

সারাটি জীবন তুমি নিজে শুধু জেলে জেলে থাকলে

আর তবু স্বপ্নের সুখী এক বাংলার ছবি শুধু আঁকলে

তোমার নিজের সুখ-সম্ভার কিছু আর দেখলে না তাই

বলো কী করে বোঝাই।”

সুধীন দাশগুপ্তের সুরে, আবিদুর রহমানের লেখা এই গানটির লিঙ্ক:

দিল্লিতে অভাবনীয় সংবর্ধনা শেষে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

টাইম ম্যাগাজিনের ভাষ্য-  ‘ঠিক দুপুর দেড়টায় প্রখর রোদের মধ্যে ঢাকার আকাশে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি কমেট জেট দেখা গেল, ঠিক তখনই জেটটি নামল না।  আকাশ থেকে শেখ মুজিব তাঁর সোনার বাংলাকে দেখার ইচ্ছে করেছেন। সে কারণে প্রায় ৪৫ মিনিট আকাশে চক্কর মেরে মেরে পাইলট তাঁকে সোনার বাংলাকে দেখাল।  সোনার বাংলা তখন শ্মশান।’

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়