ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

সাত বছর ধরে হচ্ছে না বিএনপির জাতীয় সম্মেলন

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১০, ২৯ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৫:৪৮, ৩০ জানুয়ারি ২০২৪
সাত বছর ধরে হচ্ছে না বিএনপির জাতীয় সম্মেলন

বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। ঢাকায় হওয়া সে সম্মেলন ছিল দলটির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন। গঠনতন্ত্র অনুসারে তিন বছর পরপর এ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও গত সাত বছরেও সপ্তম জাতীয় সম্মেলন হয়নি। এরইমধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা মারা গেছেন। বিভিন্ন কারণে বাদ পড়েছেন কেউ কেউ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ শূন্য আছে। এছাড়া, গত সাত বছরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়েছে একটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে সভা হয়েছিল। এর পর পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় কমিটির আর কোনো সভা হয়নি।

কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি জেলা-উপজেলাতেও স্থবির হয়ে আছে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের আগে সংগঠন গোছানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পরিপূর্ণভাবে করতে পারেনি দলটি। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৫০টিরও অধিক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলে জানা গেছে। অনেক জেলায় আংশিক আহ্বায়ক কমিটি হলেও দীর্ঘদিনেও সম্মেলন না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়নি।

বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা ৮২। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এর মধ্যে মাত্র ১০টিতে কার্যকরী কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার আংশিক। ৫২টি জেলায় আহ্বায়ক কমিটি। বাকিগুলোর হালনাগাদ তথ্য নেই। সব মিলিয়ে ৫০টির বেশি জেলা কমিটি কয়েক বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ।

বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা কমিটির মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু, অধিকাংশ জেলা-উপজেলা কমিটির মেয়াদ ৩ থেকে ১০ বছরে গড়িয়েছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নানা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে কেটেছে দীর্ঘ সময়। এ অবস্থায় সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন বা শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেননি দলের নীতিনির্ধারকরা। তাছাড়া, হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতনসহ ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে সংগঠন গোছানোর কাজটি করে উঠতে পারেননি তারা।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুরোদমে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিল বিএনপি। সেই সময় মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি করার উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সম্পন্ন করা যায়নি। ওই সময় মাত্র ২০টির মতো জেলা কমিটির সম্মেলন করা সম্ভব হয়েছিল।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে পাঁচটি। এছাড়া, ভাইস চেয়ারম্যানের ১৩টি, উপদেষ্টার ১৫টি, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকসহ প্রায় ১০০ পদ শূন্য হয়ে আছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

দলীয় সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের পর বেশ কয়েকবার ঢাকার নেতৃত্বে রদবদল করা হয়েছে। এতেও তেমন সুফল পায়নি বিএনপি। এ কারণে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণে দুই ভাগ করে পৃথকভাবে দুটি কমিটি করা হয়। এতেও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় ২০২১ সালের আগস্টে ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হককে সদস্য সচিব করে ঢাকা উত্তর এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামকে আহ্বায়ক ও রফিকুল ইসলাম মজনুকে সদস্য সচিব করে দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তরের ৭১টি ওয়ার্ডের সব এবং দক্ষিণের ৮০টির মধ্যে ৫৬টিতে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, ঢাকা মহানগরের দুই অংশের বর্তমান নেতারা নানা তৎপরতায় রাজধানীতে আন্দোলন জমানোর চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি।

আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি দুটি সহযোগী ও ৯টি অঙ্গসংগঠন। তবে, এগুলোর সাংগঠনিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। নতুন কমিটি না করাসহ বিভিন্ন কারণে ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ায় এসব কমিটিতে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ছাত্রদল ও শ্রমিক দল গঠনতান্ত্রিকভাবে বিএনপির সহযোগী সংগঠন। অঙ্গসংগঠন হিসেবে আছে—যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, জাসাস ও মহিলা দল। এসব সংগঠনের মধ্যে কয়েকটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকলেও বেশিরভাগ কমিটির মেয়াদ নেই। সবচেয়ে করুণ দশা শ্রমিক দল, ছাত্রদল, মহিলা দল ও জাসাসের।

বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক জানান, তৃণমূল পর্যায়ে অধিকাংশ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। মাঝে-মধ্যে কমিটি করতে গেলে বিশেষ ‘সিন্ডিকেট’ তাতে হস্তক্ষেপ করায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময়েও জেলা শাখা ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মী দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অনেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে অনেক জেলায় নামকাওয়াস্তে পালিত হয় আন্দোলন কর্মসূচি। চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জসহ অন্তত ৪০টি সাংগঠনিক জেলায় কর্মসূচি পালনে শৈথিল্যের অভিযোগ পেয়েছে দলের হাইকমান্ড। এসব জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নানা কারণে কর্মসূচিতে সক্রিয় নন। তাদের কেউ বিদেশে, কেউ রাজধানীতে থাকেন। এ অবস্থায় দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাউন্সিলের মাধ্যমে সব সাংগঠনিক জেলা ও তৃণমূলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, দলের অনেক সাংগঠনিক জেলা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে। সেগুলো ঢেলে সাজানোর কাজ শিগগিরই শুরু করা হবে। এর পাশাপাশি আমাদের যে মূল আন্দোলন অর্থাৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন, সেটাও অব্যাহত থাকবে।

সার্বিক বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, কমিটি গঠন করা বা হালনাগাদ করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আন্দোলনেরর পাশাপাশি দল পুনর্গঠনের কাজও চলছে। ২০২২ সাল থেকে সরকারের পতন, তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলের চেয়ারপার্সনসহ দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হওয়ায় দল পুনর্গঠন কার্যক্রম নিয়ে তেমন কাজ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে আবারো সে কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। এর মাঝেও অনেক জেলায় সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। দু’-একটি ছাড়া সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠন হয়েছে। নির্বাহী কমিটির পদও প্রয়োজনমতো পূরণ করা হচ্ছে।

রুহুল কবির রিজভী বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার যেখানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামতেই দিচ্ছে না, নামলেই মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার করছে, সেখানে কীভাবে সম্মেলন করব? তারপরও সারা দেশের সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে কমিটি করা এবং নেতাকর্মীদের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা কাজ করছেন। আশা করছি, অচিরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

/রফিক/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়