ভয়ংকর অভিযান এবং মৃত্যুসংবাদ
ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম
আমিয়াখুমের পথে অভিযাত্রী দলের বাঁশের ভেলায় ভ্রমণ
ফেরদৌস জামান
আমিয়াখুম অভিযানের পরিকল্পনা হয় ২০১১ সালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বসে। পরিকল্পনার মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে পরিচয় হয় উদয়, রাহী ও পিয়ালের সঙ্গে। এরপর ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে খোঁজখবর নেয়া এবং এ উপলক্ষ্যে একাধিক মিটিং। সবশেষে উপযুক্ত সময় হিসেবে যাত্রার তারিখ নির্ধারণ হয় ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি। শীতে ঠক্ঠক্ করে কাঁপছে দেশের মানুষ। সেই হিম জড়ানো শীতের রাতে ঢাকার কলাবাগান থেকে বাসে উঠে বসলাম রাত এগারোটায়। উল্লিখিত তিন জনসহ দলের সদস্য রোকন, ভাট্টি, সুজিত, আদিত্য, মেহেদি এবং আমি।
কুয়াশার কারণে সামনের দশ ফুট দূরের জিনিস দেখতে কষ্ট হয়। ফলে বাস চলতে শুরু করল সাবধানে। ভোরে গিয়ে নামলাম বান্দরবান। সেখান থেকে অন্য একটি বাসে থানচী। চিম্বুক রেঞ্জের শিরদাঁড়া দিয়ে পথ, বরাবরের মতো পাঁচ ঘণ্টায় পাড়ি দিলাম প্রায় ৮০ কি.মি.। থানচী বাসস্ট্যান্ডে নেমেই দেখা হলো তিনজন অভিযাত্রীর সঙ্গে। পেছনে তাদের দলের আরও দুইজন রয়েছেন। আমরা পাহাড়ে উঠছি আর তারা অভিযান শেষ করে নামছেন। সামান্য কয়েক মিনিট দেরি হওয়ায় তারা থানচী থেকে বান্দরবানের দিনের শেষ বাসটি মিস করেছেন। দলের একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। পাতলা বিদ্ধস্ত চেহারা, গোলাকৃতি মুখে হালকা দাড়ি, চোখে-মুখে ঈষৎ হেঁয়ালি মাখা হাসি (কখনও কখনও এই হাসি তাদের ঠোঁটে দেখা যায় যারা নিজেকে অভিজ্ঞ অথবা জ্ঞানী ভাবেন)। টুকটাক বাক্য বিনিময়ের পর আমরা আমাদের পথে চলতে শুরু করলাম। নদীর পাড়ে এসে মুখোমুখী হলাম বাকি দুজনের সঙ্গে। তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। তারা দুজনেই আমাদের দেখে ছোট্ট করে উচ্চারণ করলেন, বেস্ট অব লাক!
রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো বাজারে কাঠের তৈরি রেস্ট হাউসে। রাতের খাবার খেতে গিয়ে গাইডও ঠিক হয়ে গেল। দুই দিনের জন্য এক হাজার টাকা। তিনি ছেলের পড়াশোনার টাকা সংগ্রহের জন্য গাইডের কাজ করেন। তাকে নিয়েই তৈরি হলো পরের দিনের পরিকল্পনা। ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। এরপর একটানা হাঁটতে শুরু করলাম। পৌঁছে গেলাম বোর্দিংপাড়ায়। দিনটি ছিল জানুয়ারির ১২ তারিখ। কুয়াশা তখনও ঢেকে রেখেছে চারদিক। পদ্মঝিরির উজান ধরে এগুতে থাকলাম। গাইড বলল, এক সময় এই পথে বাঘ, ভালুক ও বিষধর সাপ দেখা যেত। এখন আর দেখা যায় না। তার কথাতেই জানলাম, পরবর্তী ৭-৮ ঘণ্টার যাত্রাপথে পানির কোনো উৎস নেই। অতএব যা পান করার বা সঙ্গে নেয়ার তা এখান থেকেই নিতে হবে। পথে মিলেছিল একটি কাঁচা বাঙ্গি, পানির সঙ্গে সকলেই এক ফালি করে খেয়ে নিলাম।
এখান থেকে পথ উঠে গেছে উপরের দিকে। আমাদের যেতে হবে সবচেয়ে উঁচুতে বমদের সিম ত্লাং পী পাড়ায়। সকলের অবস্থাই নাকাল! পাড়ায় পৌঁছে সকলেই গা এলিয়ে দিল। অর্থাৎ শুয়ে পড়লাম সটান হয়ে। এক ফাঁকে মোবাইল ফোনের সুইচ অন করতেই একটি কল ঢুকে পড়ল। রাহীর বাড়ি থেকে ফোন। ওর মা হাসপাতালে ভর্তি, চারপাশে কান্নার রোল, চাচা রওনা হয়েছেন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। জানা গেল বান্দরবান-থানচী রুটে বাস দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। ফলে রাহীর বাড়িতে সবাই ওর জন্য চিন্তা করছে। ফোনেই জানিয়ে দিলাম আমরা ভালো আছি। ওপাশ থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল।
আমরা দ্রুত রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্য থংদুয়াইয়ের দিকে। খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে জিকজ্যাক ট্রেইল, বান্দরবানের অন্যতম বিপজ্জনক পথ এটি। একবার পা হড়কালে নিশ্চিত মৃত্যু। গিয়ে পড়তে হবে হাজার ফুট নিচের গহীন সবুজ অরণ্যের মধ্যে। আমরা সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। ভেবে দেখলাম, আড়াই দিনের ট্রেকিং এক দিনে হয়ে গেছে, শরীরের উপর এতটা চাপ দেয়া ঠিক নয়। সুতরাং সেখানেই রাতে থেকে বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলাম।
কীভাবে যে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল টেরই পেলাম না, যেন এইমাত্র ঘুমিয়েছিলাম। যাই হোক, প্রস্তুত হয়ে আমরা পুনরায় রওনা হলাম। পাড়ার দক্ষিণে ঘন সবুজে ঢাকা পাহাড়টা ডিঙ্গাতে হবে। শেকড় লতা ধরে ধরে উঠতে হলো। পেছনে তাজিনডং, সামনে প্রায় অদৃশ্য সাকাহাফুং, মাঝের পাহাড়টার পিঠের ওপর দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম বুলংপাড়ার উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে গেলাম দুপুর দুইটার মধ্যে। পাড়ার কারবারীর ঘরে থাকার ব্যবস্থা হলো। নিচে গোটা ত্রিশেক শূকরের থাকার ব্যবস্থা, তার উপর মাচায় বেশ বড় ঘর। আমাদের স্থান হলো সেখানেই। টসটসে পাকা পেঁপে পেয়ে সকলের মুখে তৃপ্তির হাসি। বিশ্রাম এবং খাওয়া শেষে বিদায় দিতে হলো গাইড বিশাই চন্দ্র কারবারীকে। দুদিনে বেশ খাতির জমেছিল, ঠাট্টার ছলে রোকনকে তো ভাইঝির জামাই বানানোর প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছিলেন। যে কারণে আমাদের দলের রোকনকে আজও কারবারীর ‘ভাস্তি জামাই’ সম্বোধন করা হয়।
প্রকৃতির বিশেষ যত্নে গড়ে ওঠা সাতভাই খুমের সৌন্দর্য বর্ণনার চেষ্টা আমার কাছে ধৃষ্টতার সামিল বলে মনে হলো। দুই পাহাড়ের মাঝে শান্ত গিরিখাদ, পাথরের পাতলা পরতে খাঁজ কাটা দুই পাশের দেয়াল, গম্ভীর গতিতে বয়ে যাচ্ছে টলটলে স্বচ্ছ পানি। শচীনের কাছ থেকেই জানলাম, স্থান ভেদে পানির গভীরতা ১৫ থেকে ২০ ফুট। নীরব নিস্তব্ধ খুমের দেয়াল ধরে ঘণ্টাখানেক ট্রেকিং এর পর পাহাড় ধসপ্রবণ এলাকা। পাহাড়ের সুউচ্চ দেয়াল ভেঙে অনবরত ছোট ও মাঝারি আকারের পাথর খসে পড়ে। টাটকা টুকরোগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, একটু আগেই এগুলো ধসে পড়েছে। গাইডদের পরামর্শে দ্রুত এলাকাটি পার হতে হলো। এরপর নাখিয়ং মুখ, বহুদূর থেকে পানির ধারা এসে পতিত হয়েছে খুমের বুকে। ঝরনাটির নাম নাখিয়ং, সে অনুসারে নাম হয়েছে নাখিয়ং মুখ। দেখা হলো এক মাছ শিকারী দম্পতির সঙ্গে। রাতভর তারা মাছ ধরেছেন। কয়েক কেজি মাছ পেয়েছেন। রাতে খাওয়ার জন্য মাত্র ১২০ টাকা দরে আড়াই কেজি মাছ কিনে নিলাম।
বৃহদাকার সব পাথরের পাশ দিয়ে, নিচ দিয়ে, নানাভাবে পানি গিয়ে এবার যুক্ত হয়েছে খালের আরেক অংশে। চোখ ধাধানো কারুকার্যের আমিয়াখুম। দুপাশে পাহাড়ের খাড়া দেয়াল, পানির গভীরতা প্রায় ৫০ ফুট। পাশ দিয়ে কোনো ট্রেইল নেই, সুতরাং ভেলাই একমাত্র গতি। দুইজন গাইড নেয়ার মূল কারণই ছিল বাঁশ কেটে ভেলা বানানো। মৎস শিকারীদের কল্যাণে তার আর দরকার পড়ল না। প্রস্তুত ছিল ভেলা, প্রতি ট্রিপে তিনজন করে পারি দিতে হলো। গা ছমছমে রোমাঞ্চকর পরিবেশ। বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের নৌপথে গলা ছেড়ে কেবলই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে উপায় নেই। নড়বড়ে ভেলা। দুলে উঠলেই বিপদ। সুতরাং চুপচাপ বসে থাকতে হলো।
ভেলা থেকে নামতেই দেখি ধূসর বর্ণের একটি হরিণ। চিড়িয়াখানায় বন্দী পশু এবং জঙ্গলের উন্মুক্ত পশু দেখার মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভূতি। হরিণের গতি, প্রকৃতি নিয়ে চললো ছবি তোলার দীর্ঘ
রাইজিংবিডি.কম