ঢাকা     রোববার   ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৮ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: পঞ্চম পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ৮ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৯:৫২, ৮ নভেম্বর ২০২২
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: পঞ্চম পর্ব

ক্যাথলিক সড়কগুলো, কোনো ফুটপাথ ছাড়াই, পথের প্রান্তেই ময়লা, নোংরা কাপড় গুটি পাকিয়ে আছে, কুকুরের শুকনো বিষ্ঠা, সব রকমের আকার আর আকৃতি, ভাঙা চীনের টুকরা।

‘ওহ, মাদাম লেস্যু!’ লোকটা প্রায় কেঁদে ফেললো, আনন্দে। ‘তো মাদাম চেদ্রু কেমন আছেন?’ ‘আসুন, ভেতরে আসুন! তিনি ডেটিংয়ে যাচ্ছে ওরা যেমন বলে, জিজ্ঞেস না করাই ভালো...’ তার যুগল বিছানা থেকে, একজন নারী তাকিয়ে থাকে আমরা যখন প্রবেশ করি, তিনি তখন পুরোটাই হলুদ। আর তারপর সেই নারী তার মুখ খোলে, পিক ফেলে, হাসে, খুশিতে, যখন তার বিছানার চাদরের সাথে সে বেহালা বাজানোর মতো খেলে তখন হাসি থামানো যায় না আর আমি দেখি তার মুখের উপর দুটো দাঁত ঝুলে আছে যেন দুটো আনন্দ। 

তাকে দেখে মনে হয় যেন সে লাফাচ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে, বিছানার তলায় বিছানার চাদরের আড়ালে লুকাচ্ছে আর আমাদেরকে বলছে তাকে খুঁজে বের করতে, তাকে খুব সুখী দেখায়। চোখের পলকে, সে তার নাইটগাউন টেনে তোলে, একটা বড় কৃষ্ণ গহ্বর যেন ভেতর থেকে সব মাংস শুয়ে নিয়েছে। আমার মা তার উপর ঝুঁকে আসে আর বুড়ো লোকটাও তা করে, তিনি নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু বের করতে যাচ্ছেন, বলি রেখায় লুকিয়ে রেখেছেন একটা কাঁকড়া, পিঁপড়েরা সাঁতার কাটছে চারপাশে যেন চিনির প্যাকেটের তলা। আর আকস্মিক পাদের গন্ধ, সিদ্ধ পাতাকপির। তার পা। বৃদ্ধা নারীটি নাইটগাউনটি আরো উপরে তুলতে গিয়ে কেঁপে উঠছে। তার দুপায়ের মাঝখানে শুকিয়ে যাওয়া হিসুর সমুদ্র, রেখার প্রান্তে গোলাপী, ম্লান সূচিকর্ম যেন। ‘ওইখানে,’ আমার মা বলে, ‘এখন তুমি ভালো বোধ করবে।’ তারা ঘুরে দাঁড়ায়, বুড়ো লোকটা আর আমার মাও। ঠিক এখনই সময় দেখি বিছানার চাদর আবার নিচে নেমে গেছে, হাতগুলো আবার তালগোল পাকিয়ে গেছে, তার মুখ থেকে তোতলামি শুরু হয়েছে।   

আমার মা দ্রুত কিছু কফি, বিস্কুট নেয় আর তার ব্যাগ থেকে এক পাত্র কালভাডো বের করে। আবার হাসি শুরু হয়, বুড়ো লোকটাও যোগ দেয়, সে মায়ের জিনিসগুলো নিতে চায় না, মা সেগুলোকে তার আরও কাছে ঠেলে দেয়। ‘আপনার এমনটা করা উচিত নয়!’ এসব কিছুর পর, আমার মনে হয় যে আমাদের এখন বসার অধিকার হয়েছে আর চারপাশে ভালো করে তাকানোর সময় হয়েছে। বুড়ো লোকটা নিশ্চয়ই কাপড় ইস্ত্রি করছিল, টেবিলের এক কোণায় একটা কম্বল ছড়ানো আর একটা ইস্ত্রি স্টোভের পাশে গরম হচ্ছে, কফি পটের ঠিক পাশেই। কিছু কাপড় শুকানোর জন্য ঝুলিয়ে দেয়া আছে। হাগু করার পাত্রটা লুকানোর সময় পাননি তিনি। আমরা কি এখানে খাওয়া-দাওয়া করতে যাচ্ছি? আমি সন্দিহান, বুড়ো লোকটা সাইডবোর্ড খুললেন কিছু গ্লাস বের করার জন্য, ভেতরে কিছুই ছিলো না, কোন মিষ্টি, কোন বোতলজাত ফল। 

আমি খুব হতাশ হলাম, আমাকে কিছু না-দেয়ার জন্য আমি বিরক্ত করা শুরু করলাম। ‘যাও, খেলা করো গে!’ মা আমার কানে ফিসফিস করে বললো। সে বুড়োটার সঙ্গে গল্প করতে লাগলো যখন তার বউ মনে হচ্ছে চোখ খোলা রেখেই ঘুমাচ্ছে। আমি ইতোমধ্যেই ঘরের অন্য দিকে চলে এসেছি, তাক ভর্তি নানা আকারের আর আকৃতির বোতলভরা দেখছি, ওয়াইন, সিরাপ, সুগন্ধী, কোনটার মুখ এতো সরু যে আমার সরু আঙুলও ঢুকাতে পারি না তাতে। চ্যাপ্টাটার মাথাটা বিরাট, কোনোটা লম্বা আর সরু, কোনোটা সবুজ মাথার দিকটার কাচ আরো মোটা। একটা তো একেবারে গোলাকার ছোট্ট একটা ঘাড়সহ এবং সেটা উপরের দিকে যতো গিয়েছে ততো বড় হয়ে উঠেছে আর বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে যেন। ঠান্ডা। আমি এর ধুলো ঝাড়ি আর ততোক্ষণ পর্যন্ত এর মধ্যে ফুঁ দিতে থাকি যতোক্ষণ এটা সাদা আর মেঘাচ্ছন্ন মতো হয়ে না-যায়। আমি বাথরুমে যাবার জন্য মরে যাচ্ছি। কিন্তু আমি চাই না কেউ আমাকে দেখে ফেলুক। আমি চারদিকে তাকাই, বুড়ি মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে তার অচেতন চোখ দিয়ে, তার দুইটা দাঁত বাইরে বেরিয়ে আছে আর সে আবার হাসতে শুরু করেছে ও হাত দুলাচ্ছে। আমি নিশ্চিত নই, সে তার নুয়ে পড়া চিবুক ঝুলিয়ে বলছে, ‘তুমি খেলো, লক্ষ্মীটি, ঠিকাছে ওটা, তুমি খেলো।’ 

সে কি জেনে গেছে আমি কী করছিলাম? হয়তো সেও বোতল নিয়ে এমন করতো, হয়তো এখনও এমনটা করতে সে পছন্দ করবে। তার দাঁত নড়বড়ে, এর মাঝখানে জিভ আড়ষ্ট... অস্বস্তিকর, বোতলটা ধরে আছে, সেই বৃদ্ধা নারীর সঙ্গে কে জানে কি হচ্ছে। আমি জানি কীভাবে কি হয়েছে, বোতল ভেঙে যায়, কিছু কিছু কার্পেটের ফুলের মতো জিনি বৃদ্ধের চেয়ারের চারপাশে ছড়িয়ে আছে... আমার মা ওঠে পড়ে, প্রচন্ড ক্ষিপ্ত, জিনিগুলো গোছাতে থাকে। ‘‘এটা ব্যাপার না, আসো, এটা আমাদের বিক্রি করে দেয়া হাত ধোয়ার পাত্রের কাছে থাকতো।’ বৃদ্ধা নারী তার বিছানায় হৈচৈ করছেন, বলতে চাচ্ছেন আমরা এগুলোকে একত্রে আঠা লাগাতে পারবো, কেউ তার কথা শুনছে না। ‘আমি হিসু করবো!’ আমার মা জিজ্ঞেস করলেন এদিকে টয়লেট আছে কি না। আঙিনার দিকে। অথবা হাগুর পাত্রে করতে হবে। 

বৃদ্ধা নারী আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। একবার ঘর থেকে বেরুতে আমি সেটা আর অনুভব করি না। আঙিনায় খরগোসের ঘর দেয়ালের দিক থেকে শিক দিয়ে বানানো, আরেকটা দেয়ালের দিকে কাছের টুকরা জড়ো করা। একটা নাশপাতি গাছও আছে, কেবল তিনটা, চারটা, পাঁচটা নাশপাতি ধরে আছে। এইখানে আমি ছোট্ট চত্বরে চুপ করে আছি, দূরে মা আর সেই বুড়ো লোকের কথা শুনতে পাচ্ছি, তাদের কণ্ঠস্বর ওঠানামা করছে, আকস্মাৎ বৃদ্ধা নারীর অস্পষ্ট কথা শুনতে পাচ্ছি... আমাদের উত্তাল ক্যাফের থেকে কতোই আলাদা। ঠিক এখনি আমার বাবা ডমোনি খেলায় জিতে গেছেন- আমি এসব ভাবছি। ওদের মাত্র একটি কক্ষ, বৃদ্ধ চেদ্রু দম্পতি, আমার মা তাদের জন্যে খাবার এনেছে, বিনা পয়সায়। আমাদের অবস্থা ওদের চেয়ে ভালো। ওদের সাইডবোর্ডে কিচ্ছু নেই। সেটা ময়লাও। দেখা যাচ্ছে বুড়ো লোকটা আমাকে মাকে দেখে খুশি হয়েছে। সে কথা বলা থামাচ্ছেই না, মা শুনছে, সে যতো ভালো ভালো থাকা যায় তাদের প্রতি ততোটাই ভালো। আমি নিজের উপরেই খুশি। আমি এখানে আসতে পেরে আনন্দিত, যতোক্ষণ আমি ড্যানিস লেস্যু হয়ে থাকতে পারছি। আমি নিজেকে ডেনিস চেদ্রু হিসেবে কল্পনাও করতে পারছি না, এইসব শিশি বোতল আর হিসুর মাঝখানে। বুড়ো লোকটা কী বলবে যদি আমি তার একটা নাশপাতি হাপিস করে দেই? কিচ্ছু বলবে না, তার সাহসই হবে না, বিশেষত আমরা যা কিছু তাদেরকে দিয়েছি। 

যখন তুমি চাপ দিবে ওগুলো শক্ত, কিন্তু যখন আমি নখ ঢুকাই কিংবা এর ছাল একটু ছাড়াই তখনই এক ফোঁটা মিষ্টি রস ছড়িয়ে পড়ে। বেশ, যাই হোক, তিনি কেন প্রথমেই নিজে থেকে আমাকে একটা দিলেন না, এইটাই তো তার সব যা থেকে আমাকে নিবেদন করতে পারতেন? আমি আমার সবগুলো দাঁত এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেই। একটা কড়মড় শব্দ, আমি নিজেকে সংযত করি পুরো নাশপাতিটা ছিলে ফেলা থেকে। শক্ত, কটূ। তার উচিত ছিলো আমাকে একটা দেয়া, তাহলে তো আমি নিজে এটা হাপিস করে দিতাম না। এগুলো তো সহজেই হয়। আর আমার তাদেরকে কিছু কফি, একটা মদ দিয়েছে। নাশপাতির তো এমন দামও নয়। আমি এক টুকরো মুখের ভেতরে নেই, আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি তিক্ত, নাশপাতিটা ওখানেই তার জায়গাতে ঝুলে রইলো ঠিক মাঝ বরাবর একটা কামড় সহ। তিনি হয়তো ভাববেন এটা বড় কোন পাখি খেয়েছে। হয়তো দাঁতের দাগ দেখতে পাবে, বরং পুরোটা খেয়ে ফেলাই ভালো। সেটাই, সঠিক শিক্ষা হবে ওর জন্য।

যেই আমরা বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম, রু ক্লোপার্তের উপর থেকেই হলুদ অবয়ব দেখা যাচ্ছিলো আর বড় বড় অক্ষরে লেখা CA FE শব্দটি দরজার উপরে দুই দিক থেকে আলাদা হয়ে ঝুলে আছে, আমি মাকে এক গাদা প্রশ্ন করতে থাকলাম। চেদ্রুরা কারা, ওরা কেন ওখানে থাকে? ‘‘পুন্যাত্মা, তারা একটা মাছিকেও আহত করবে না। তারা ছিলো ভালো ক্রেতা, যখন সেই নারী একদম ঠিক ছিলেন আর তার পা ঠিক ছিলো। তারা বোতলে বোতল ওয়াইন কিনতেন, আর রবিবারে কাঁকড়া। এখন তেমন কিছু কেনেন না, নেহাত কিছু  নোনা মাংস আর পোর সালু । দুনিয়াতে ওদের মতো অনেক গরিব মানুষ আছে, আমরা তাদের অবহেলা করতে পারি না।’’ 

মা দ্রুত হাঁটছে, অনেক গল্প করছে, সে নিশ্চয়ই তৃপ্ত বোধ করছে, ‘‘ওরা আমাদের জীবিকার অংশ ছিলো, দেখো। বিশ্বস্ত ক্রেতা, কখনো অন্য কোথাও যায়নি।’’ তাই আমিও আনন্দিত বোধ করি, চেদ্রুদের নিয়ে খুশি, বিকালটা নিয়ে খুশি, খুশি দুপায়ের মাঝখানের বৃদ্ধা ফাঁকা স্থান নিয়ে যেখানে টফির মোড়ক থেকে উঁকি দিচ্ছে। আমি বীজগুলোকে নাশপাতি গাছের মাথার উপরের মেঘে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর ফলের অবশিষ্টাংশটা খরগোসের খাচার দিকে ঠেলে দিয়েছি।

রোববারের যাত্রাটা ছিলো পঙ্গু বালিকা রেঁজ’কে দেখতে যাওয়া, ডাইনিং রুমের টেবিলে প্লাস্টিকের ফুল, একটা গাছের বাকলের অংশ লরেডের  প্রতিনিধিত্ব করছে, অন্ধকারে ভার্জিন মেরি’র একটা মূর্তি জ্বলছে যা আমাকে ভয় দেখায়, আরেকটায় পবিত্র জল ভরা। মা তার জন্য ‘ট্রু কনফেশন’ পত্রিকার পুরনো কিছু কপি এনেছে। রেঁজ’র বৃদ্ধা মা তার বুড়ো আঙুলটি হারিয়েছে। সে সব সময় তার অন্য মেয়ের কথা বলে আর কি করে মেয়ের জামাই ছেলেমেয়েদের মধ্যে যক্ষা ছড়িয়েছে তা বলে। একগুচ্ছ রবিবারের বিষাদ গল্প, সব সময়ই নতুন একটা গল্প থাকেই, রঙিন ছবি থাকে... রক্তে থুতু, রুমাল ভরে গেছে রক্তে, সেই সব চোখগুলো, মাদাম, সেই সব চোখগুলো, বৃদ্ধাঙ্গুল চাবানো গোড়া, পিতলের রান্নার পাতিলের সবুজাভা, অবিশ্বাস্য। বিষণ্ন গল্পগুলো আমার কাছে দূরবর্তী, এগুলো আমার জীবনে ঘটবে না, কারণ এমন লোক আছে যারা অসুস্থ হয়, যারা কেবল মাত্র পঞ্চাশ ফ্রাঁ দিয়ে পাঁতে  কিনে খেতে পারে, আর তারপর আমার মা কিছুটা এদের দূর্ভোগ কমাতে পারে, বৃদ্ধ লোকগুলো শীতে যাদের নাক দিয়ে জল ঝরছে আর বেমানান বুটজুতোগুলোর ফিতে বাঁধে। এটা তাদের দোষ নয়, আমাদেরও নয়। এইভাবেই সব কিছু চলে আর আমি এতেই সুখি।

বসন্তকালের রবিবার, সবগুলোই ঝলমলে, রোদে সারি ধরে কাপড় শুকাচ্ছে, মুরগিগুলো ডাকছে। কিছুদিন পরে বুড়ি কুত্তিটা যে স্কুলে বলেছিলো, ‘বলো না, ‘আমরা কোন দিনে আছি আজ? এটা ভুল,’’ আমি যা কিছু জানতাম তা হলো আমি পা থেকে মাথা অবধি রবিবার ছিলাম, আমার সেরা রবিবারে, মুখ ভর্তি ক্রিম আর কাল্পনিক কমিউনিয়ন ওয়েফার। আমি এর সবটাই ভালোবাসতাম, টিনের কৌটায় সার্ডিন মাছ, ঋণিগ্রস্থদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আর আমার মায়ের এলিয়ে পড়া, আমি এর সব কিছুই পছন্দ করতাম।

আজ, আমার মা প্রার্থনায় থাকবেন, আমার পরীক্ষায় পাশ করার জন্য দোয়া করবেন। সে তো প্রার্থনা করেনি তার কন্যা, একমাত্র কন্যার গর্ভবতী না-হওয়ার জন্য। কিংবা হয়তোবা করেছে, কারণ এটাই তো তার সবচেয়ে বড় ভয়, তার চূড়ান্ত বিপর্যয়। (চলবে)  

পড়ুন: নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: চতুর্থ পর্ব          

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়