ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ছোটগল্প || ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধান

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ২৭ জুন ২০২৩   আপডেট: ১০:৩৭, ২৮ জুন ২০২৩
ছোটগল্প || ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধান

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

আমার বেঁচে থাকা সব নষ্ট করে দেব; একে একে মৃত্যুগুলোও। ভোলা মাস্টার অঙ্কের ক্লাসে হঠাৎই চিৎকার করে বলে উঠলেন। এরপর চক-ডাস্টার টেবিলে সযত্নে রেখে খুব ধীর পায়ে বের হয়ে গেলেন ক্লাস থেকে। স্কুলের বামের রাস্তাটা বেখেয়ালে ঢুকে পড়েছে গ্রামের ভেতরে, ডানে উদোম মাঠ, অনন্ত হাহাকার। এই প্রথম তাকে ডানের রাস্তা ধরে পড়ন্ত বিকালের সূর্যের মতো দাঁড়িয়ে থেকে নির্লিপ্তভাবে হাঁটতে দেখা গেল। একটা দলছুট মেঘ এসে আলোটা ঢেকে দিলে নিজের ছায়ার মতো অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।

প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনাটা এভাবেই বলবে সেদিনের ক্লাসের ছাত্ররা; তবে একটা অংশ। আরেকটা অংশের ভাষ্য বলবে, ভোলা মাস্টার সেদিন চক-ডাস্টার টেবিলে সযত্নে রেখে খুব ধীর পায়ে বের হন বটে, তবে ডানে বা বামে নয়, সোজা হাঁটা দেন, এবং পুকুরের পাড়ে ঝুরিবিহীন দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটার আড়াল পড়ে গেলে তাকে আর দেখা যায়নি। 

আরো পড়ুন:

এ দুটোর বাইরে সর্বশেষ আরও একটা ভাষ্য তৈরি হবে ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধান নিয়ে; একক ভাষ্য। ক্লাসের বাইরে ঘণ্টায় বাড়ি দেয়ার জন্য বের হবেন আলীসাত্তার। তার ভাষ্যে প্রচারিত হবে, ভোলা মাস্টার সেদিন ক্লাস থেকে বেরই হননি। ছুটির ঘণ্টা পড়লে ছাত্ররা যে যার মতো শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু ভোলা মাস্টারকে সে বের হতে দেখেনি। 

কিন্তু ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধান নিয়ে এই একাধিক ভাষ্যে গ্রামের মানুষের মধ্যে কোনো বাহাস হবে না। কোনো ঘটনারই একক বয়ানে তারা স্থির হবে না- মানুষ এখানে এমনই। তাই কালে কালে একটি ঘটনার আরো অনেক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ঘটনাটিকে তারা প্রায়শই জীবন্ত করে তুলবেন। যেমন ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধানের পঞ্চাশ বছর পর নতুন করে শোনা যাবে, অন্তর্ধানের দিন তিনি আসলে ক্লাসেই আসেননি। সেদিন ক্লাসে আসা ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র যে পরবর্তীসময়ে আলেম হবে, সেই মৌলানা রশিদুল ইসলাম মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে জুম্মার খুতবায় একথা বলবেন। অবশ্য তার বক্তব্যের মূল বিষয় ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধান হবে না। তিনি ইসলামে শিক্ষকের গুরুত্ব বোঝাতে ভোলা মাস্টারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলবেন, বুখারি শরিফে বর্ণিত আছে রাসুল (সা.) ইসলামে শিক্ষকের গুরুত্ব বোঝাতে বলেছেন: ‘আল্লাহর পরে, রাসুলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব, যে বিদ্যার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।’ ভোলা মাস্টার আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ। সেদিন ভোলা মাস্টার ক্লাস নিতে স্কুলে আসেননি। আমি নিজে স্কুলে ছিলাম। আমরা অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য। কিন্তু তিনি বিদ্যা প্রচারের জন্য সংসারত্যাগী হয়েছেন। আল্লাহর হেদায়েত যার উপর নাজিল হয় তিনি শুধু তার গোত্রের শিক্ষক না, মানবজাতির শিক্ষক হয়ে ওঠেন। ভোলা মাস্টার আজও…।’

ইমামের কথা শেষ না-হতেই পেছনের দিক থেকে এক যুবা বয়সী হাফেজ প্রশ্ন ছুড়ে বসবে, ভোলা মাস্টার তো হিন্দু, তাছাড়া অঙ্কের মাস্টার। দ্বিনের আলো প্রচারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে হুজুর? 

ইমাম হঠাৎ এই প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে কিছুক্ষণ কেশে নেবেন। তারপর গলা চড়িয়ে বলবেন: আল্লাহ জ্ঞানের কথা বলেছেন। অঙ্ক শিক্ষাও জ্ঞানের অংশ। পবিত্র আল কুরআনেও অঙ্কের কথা আছে। সূরা আর রহমানের ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র চলে হিসাবমত।’ এই হিসাব মানে কি? হিসাব মানে অঙ্ক। এরপর ইমাম রশিদুল ইসলাম গণিতের সঙ্গে কুরআনের সম্পর্ক বোঝাতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

কিন্তু যে প্রশ্নটা সেদিন মসজিদের ইমাম এড়িয়ে যেতে চাইবেন সেটি আবারও ছুড়ে দেবে অন্য একজন; রীতিমতো মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান হাফিজুল মেম্বার। এবার আর প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকবে না। মসজিদে একজন হিন্দু শিক্ষকের প্রশংসা করে যে নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন, ব্যাপারটি তিনি ইতোমধ্যে আন্দাজ করতে পারবেন। এবার আর না কেশে কাঁধ ও সিনা টানটান করে ইমাম সাহেব একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবেন মসজিদের মধ্যে। তিনি বলবেন, ‘আল্লাহ যা জানেন আমরা তা জানি না, আমরা তখনই জানি যখন আল্লাহ আমাদের হেদায়েত করেন। আমি কয়েক জুম্মা আগে এক স্বপ্নে দেখেছি, একজন মাস্টার পাহাড়ের ঢালে গরুর পালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা একদল শিশুকে জ্ঞান দিচ্ছেন। গভীর অন্ধকারের মধ্যে নূরানি আলো ঘিরে রেখেছে জায়গাটা। মাস্টারের মাথায় টুপি, হাতে সেই চেনা চক-ডাস্টার। চেহারাটা আমি এক ঝলক দেখলাম, আমাদের ভোলা মাস্টার। সুবানাল্লাহ!

মসজিদের সমবেত মুসল্লি সমস্বরে বলে উঠবেন, সুবানাল্লাহ।  মুহূর্তে মসজিদের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে, সুবানাল্লাহ … সুবানাল্লাহ…!

ভোলা মাস্টারের অন্তর্ধান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে আরো একটি ভাষ্য: সেদিন স্কুলে যাননি তিনি। মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব বলেছেন কথাটা। এখন এই কথার বিরোধিতা করা মানে পাপ করা। তাই অন্যান্য ভাষ্যে যারা বিশ্বাসী ছিল তারাও সুর পাল্টিয়ে ফেলবে। প্রথম ভাষ্যের স্বঘোষিত প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রচারকারীরা বলবে: দিনটি ছিল বুধবার, আর বুধবার আমাদের রুটিনে অঙ্কের ক্লাস ছিল না। তাই ভোলা মাস্টার স্কুলে গিয়েছিলেন কিনা আমরা জানতাম না। কিন্তু তার চলে যাওয়াটা আমরা দেখেছি। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে…হ্যাঁ, হাতে চক-ডাস্টারও ছিল।      

তবে এবার ভোলা মাস্টারের ক্লাসে থাকা না-থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে তার ধর্মান্তরের বিষয়টি। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণই করবেন, তখন গ্রামে থাকতে করলেন না কেন? এতে গ্রামের লোকজন গণিত শিক্ষক ভোলা নাথের লাভ-লোকসানের হিসাবও কষতে শুরু করবে। কেউ কেউ বলবে, মুসলমান হলে তো আর ইলেকশনের রাতে ভোলা মাস্টারের বাড়িটা আগুনে পুড়ত না। 

আর মেয়েটা? কেউ একজন ভোলা মাস্টারের মেয়ের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে অন্যরা বেদনায় ‘আহা… আহা…’ করে উঠবে। কারো কারো বুক থেকে বের হয়ে আসবে গভীর দীর্ঘশ্বাস। 

ধর্মান্তরিত ভোলা মাস্টারের প্রতি গ্রামের মানুষের এই সহানুভূতি-সহমর্মিতা দেখে তেঁতেও উঠবেন কেউ কেউ। বিশেষ করে হাফিজুল মেম্বার; মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান। বোঝা যাবে ভোলা মাস্টারের ধর্মান্তরের ভাষ্যটি তার পছন্দ হয়নি। অন্য ধর্মের কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে অবশ্যই তার খুশি হওয়ার কথা। এটা তার ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করবে। সেই দায়িত্ব থেকে সেদিন মসজিদের অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে সেও উচ্চকণ্ঠে সুবানাল্লাহ…সুবানাল্লাহ…বলে চিৎকার করেছে। 
তাহলে? 

এতটা বছর পরে ভোলা মাস্টার যদি ফিরে এসে বেদখল হওয়া ভিটেমাটি জমিজমা ফেরত চায়, মামলা করে! কিন্তু এই দুশ্চিন্তাটা বেশিক্ষণ দংশন করতে পারবে না মেম্বারকে। মাস্টার যে অন্তর্ধানে গেছে, সেই অন্তর্ধান থেকে সে কোনোদিনই ফিরবে না। কেউ না জানলেও মেম্বার তো জানবে এবং সে কথা স্মরণ করে সে আরো একবার সুবানাল্লাহ…সুবানাল্লাহ…বলে উঠবে আপনমনে ওজু করতে করতে।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়