ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রশংসা কুড়াচ্ছে নায়েকের মানবিকতা

আব্দুল্লাহ আল নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৩, ২৯ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
প্রশংসা কুড়াচ্ছে নায়েকের মানবিকতা

১০ মে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফোন করেন এক নারী। হাউমাউ করে কাঁদছিলেন তিনি। তিনি জানান, তার এক বছরের একটি সন্তান আছে। ঘরে খাবার নেই। শিশুটির জন্য দুধও নেই। কোনো উপায় না দেখে পুলিশের নাম্বারে ফোন করেছেন।

অসহায় এ নারীর কথা পৌঁছে যায় এসএমপির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিসে কর্মরত নায়েক সফি আহমদের কানে। তিনি তাৎক্ষণিক ওই নারীর সাথে যোগাযোগ করেন। পরে তার বাসায় এক মাসের খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যান। শিশুর জন্য নিয়ে যান এক কৌটা দুধও। ঈদের সময় ওই পরিবারকে উপহার ও নগদ অর্থও দেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর সারা দেশের মতো সিলেট নগরেও কর্মহীন হয়ে পড়েছে দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ। নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তখনই তাদের পাশে ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন পুলিশের নায়েক সফি আহমদ। তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর বাড়ি না গিয়ে খাবার নিয়ে ছুটছেন অসহায় মানুষদের দুয়ারে দুয়ারে। পৌঁছে দিচ্ছেন খাদ্য সামগ্রী, নগদ অর্থ কিংবা রান্না করা খাবার। এমন মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

সফি আহমদের এমন মানবিকতায় প্রশংসা করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিস) মো. জেদান আল মুসা। তিনি বলেন, ‘এসএমপির সদস্য সফির মানবিক কাজ প্রশংসার দাবি রাখে। অফিসের দায়িত্ব পালনের পর নিজের কথা না ভেবে অসহায়দের সহযোগিতায় কাজ করছেন তিনি।’

নায়েক সফি আহমদ জানান, ২৬ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার পরিবারের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। একই সাথে বিকাশের মাধ্যমে ১১০ পরিবারের কাছে নগদ অর্থও পাঠিয়েছেন। শুক্রবার রাতেও তিনি মোটরসাইকেলে করে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন শহরতলীর বালুচর এলাকায়। স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর কাছ থেকে তথ্য পেয়েই তিনি অসহায় কর্মহীন সিএনজি অটোরিকশার চালকের পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তা নিয়ে ছুটে যান। পাশাপাশি ওই চালকের প্রতিবন্ধী শিশুর চিকিৎসার সহায়তা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন।

সফির বাবা প্রয়াত মো. ইদ্রিস আলীও ছিলেন পুলিশ সদস্য। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। সফি আহমদের ভাই পুলিশে এএসআই পদে কর্মরত। পরিবারের সহযোগিতায় বাবার ভাতা এবং পেনশনের প্রাপ্ত অর্থ, দেশে-বিদেশে থাকা পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব আর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ দিয়েই তিনি অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

অসহায় মানুষের কাজ না করলে তার ভালো লাগে না। এজন্য সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসের কাজ শেষ করেই তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়ান নগরে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন দেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য সামগ্রী। এ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে কিছুটা ঋণগ্রস্তও হয়েছেন তিনি, দোকানে বাকিও পড়েছে। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। সকলের সহযোগিতা নিয়ে অসহায়দের মুখে খাবার সামগ্রী পৌঁছে দিতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

সফি জানান, করোনার সাধারণ ছুটি ঘোষণার কয়েক দিন পর প্রথমে তিনি নিজের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা কর্মহীন তাদের সহযোগিতা করছিলেন। এরপর সংকট বাড়তে থাকায় তিনি সিলেট নগরেও অসহায়দের মাঝে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেন। অবশ্য প্রথমে তিনি মানুষদের ঘরে রাখার জন্য টাকার বিনিময়ে খাদ্য কিনে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। এজন্য তিনি তার ফেসবুক পেজে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা হতে চাই’ শিরোনামে একটি পোস্ট দেন। সাথে তার মোবাইল নাম্বারটিও দেন। মানুষকে ঘরে রাখতে তার উদ্যোগটি ছিল এরকম- টাকার বিনিময়ে তাদের বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেবেন। কিন্তু বেশিরভাগ ফোনকল এমন ছিল- ঘরে খাবারও নেই; হাতে টাকাও নেই। এরপরই গত ২৬ মার্চ থেকে তিনি বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শুরু করেন। প্রতিদিন তিনি ১৫-২০ টি পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেন।

সফি আহমদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। তিনি শহরে থাকলেও গ্রামের অসহায় লোকদের কথা ভোলেননি। এজন্য ঈদে দুই বন্ধুর সহযোগিতায় গ্রামের ৪০০ পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী দিয়েছেন তিনি। এছাড়া, সিলেট নগরের পত্রিকার হকারদের মাঝে ইফতার সামগ্রীও বিতরণ করেছিলেন সফি আহমদ।

তিনি বলছিলেন, ‘করোনা মহামারিতে মানুষের সহযোগিতা করে তৃপ্তি পাচ্ছি। ঈদের দিন আমার সহযোগিতা পাওয়া এক মহিলা ফোন দিয়ে বলেছেন, আপনার জন্য সেমাই রান্না করে রেখেছি। এ কথা শুনে আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।’

সফি আহমদ তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি আরো বেশি অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করতে চান।

অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে প্রবাসী ও বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সফি আহমদে বলেছেন,  ‘আপনারা মাঠে না আসতে পারলে আমাকে সাহায্য করুন। আমি আপনাদের অর্থ দিয়ে সিলেটের অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করব, মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেব।’



সিলেট/নোমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়