পাল-বৈঠা-জৌলুস সবই হারাতে বসেছে কাঠের নৌকা
রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম
গাজীপুরের কালীগঞ্জ বাজার খেয়া ঘাট। স্থানীয়রা একে গুদারা ঘাট বলেই ডাকে। প্রতিদিনের পারাপারে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে জিনিসটি ব্যবহার হয় তা হলো নৌকা। আগে কাঠের নৌকায় পাল তুলে বৈঠা বেয়ে পারাপার হতো। এখন আর সেই দৃশ্য নেই।
কাঠের জায়গা দখল করেছে লোহা আর বৈঠার জায়গায় ডিজেল চালিত শ্যালো ইঞ্জিন। মাঝির আর পাল তোলার প্রয়োজন পড়ে না। কষ্ট লাঘবে যতটা না খুশি, তার চেয়ে বেশি কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
কালীগঞ্জ গুদারা ঘাটে এক সময় অসংখ্য মাঝি আর নৌকা থাকলেও সময়ের স্রোতে সেসব আজ বিলীন। অনেকেই পেশা বদল করেছেন। স্থানীয় বিভিন্ন কারখানায় চাকরি করছেন। এক সময়ের প্রাণ চাঞ্চল্যের ঘাট আজ হারিয়েছে তার জৌলুস। যে কয়েকজন আছেন, তারাও আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে কাঠের নৌকায় আর পাল তোলেন না।
কাঠের নৌকার চেয়ে লোহার নৌকার চাহিদা বেশি থাকায় মিস্ত্রিরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। মিস্ত্রিদের আয়ের মাস হলো বর্ষাকাল। কিন্তু দিন দিন কাঠের নৌকার চাহিদা হারাতে বসায় অনেকেই এখন অন্য পেশা খুঁজছেন।
উপজেলার আওড়াখালি, ছৈলারমোড়, জাঙ্গালিয়া এবং জামালপুর এলাকায় নৌকার কারিগররা বছরের এ সময়ে নৌকা বানাতে ব্যস্ত থাকতেন। এখন বহু ঘুরে দুয়েকজনের দেখা মেলে। তারাও নিজেদের পেশা নিয়ে হতাশ।
নৌকার মূল কাঠামো তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। তারপর তাতে আলকাতরা মাখিয়ে রোদে শুকাতে হয় বেশ কিছুদিন। পরে বাঁশের মাচা এবং ছৈ লাগিয়ে পানিতে ভাসানো হয়। যেহেতু কাঠের দাম বেশি এবং আগের মতো পাওয়া যায় না- তাই কাঠামো বানাতে এখন ব্যবহার করা হয় লোহার শিট। ওয়েল্ডিং করে তাতে শ্যালো ইঞ্জিন বসালেই তা ব্যবহারের জন্য তৈরি। কাঠের তুলনায় মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও বেশি।
কালীগঞ্জ খেয়া ঘাটের মাঝি মো. শরিফুল ইসলাম (৪৯) জানান, ১৪ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে বৈঠা চালানোর কাজ শিখেছেন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে একই কাজ করে যাচ্ছেন। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি লোহার তৈরি নৌকা ব্যবহার করছেন। এতে ডিজেল চালিত শ্যালো ইঞ্জিন থাকায় শারীরিক পরিশ্রম নেই। খেয়া ঘাট আগের মত জমজমাট না হওয়ায় উপার্জন কমে এসেছে।
জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এ ঘাটে কাটালেও উন্নতির দেখা না পাননি শরিফুল। একই কথা বলেন খেয়া ঘাটের অপর মাঝি মো. সাইফুল ইসলাম (৪০) এবং মো. ইলিয়াস (৩৫)।
খেয়া পারাপার হতে আসা মো. জাকির হোসেন (৫৫) বলেন, ‘আমার বাড়ি নদীর ওপারে। প্রতিদিনই খেয়া পারাপার হতে হয়। আগে নদীতে কাঠের নৌকা ছিল অনেক। এখন তা একেবারেই নেই। লোহার নৌকার ইঞ্জিনে বিকট শব্দ হয়। কিছুক্ষণ বসে থাকলে পরে আর কানে কিছু শোনা যায় না। তার ওপর এখন ভাড়াও বেশি নিচ্ছে। কাঠের নৌকায় চড়ে যে শান্তি পাওয়া যেত, লোহার নৌকায় তা পাওয়া যায় না।’
কালীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ মসলিন কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক আব্দুর রহমান আরমান বলেন, ‘কাঠের নৌকার প্রচলন এখন নেই বললেই চলে। আধুনিকায়নের ফলে হারাতে বসেছে এর ঐতিহ্য। খেয়া ঘাটে এখন আর কাঠের নৌকা চোখে পড়ে না। যাও দুয়েকটা রয়েছে তারও ভঙ্গুর দশা। কাঠের নৌকা যেহেতু গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত তাই এ শিল্পটি সংরক্ষণ করা জরুরি।’
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শিবলী সাদিক জানান, কালের পরিক্রমায় এবং জীবনের চাহিদায় মানুষ আধুনিক হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণের ফলে জীবন মান হচ্ছে উন্নত। এ অবস্থায় পাল তোলা নৌকার চাহিদা কমে আসবে এটা সময়ের নিয়ম। তবে এর সংরক্ষণের জন্য জাতীয় উদ্যেগ প্রয়োজন।
গাজীপুর (কালিগঞ্জ)/সনি