ঢাকা     বুধবার   ০৮ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

ভাত খান না ‘তালা বাবা’ 

সিদ্দিক আলম দয়াল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৯, ৩০ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৮:১০, ৩০ নভেম্বর ২০২১
ভাত খান না ‘তালা বাবা’ 

পরনে চটের লুঙ্গি আর বুকে ও শরীরে শিকল দিয়ে জড়ানো স্টিলের ও লোহার তালা। মানুষ বলেন, তালা বাবা। কখন কোথায় খাওয়া, ঘুম, তা তিনি নিজেও বলতে পারেন না। জুটলে খান আর না পেলে উপোস করেন। 

১৯ বছর থেকে ভাত খান না। অধিকাংশ দিনে রুটিই খাদ্য তার। শহর গ্রামে পায়ে হেঁটে অথবা ভ্যানে চলেন। মন যেদিকে চায় সেদিকে চলে যান। বউ ছেলে মেয়ের দিকে মন নেই। মন টানে অজানা দিকে।  

বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো, তার আসল নাম মনজিল ইসলাম। বয়স ৬৫ বছর। বাবার নাম মেহের উদ্দিন। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের মলাবান্দি গ্রামে।   

গিদারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুজ্জামান রিংকু বলেন, সার্বক্ষনিক কমপক্ষে ২০ কেজি ভারী বস্তু তিনি শরীরে বহন করেন। 

বাবা মেহের উদ্দিন ছিলেন ভারতের পীর খাজা তিস্তা খঞ্জন সাধুর মুরিদ। মনজিল ইসলামের বয়স যখন ১১ বছর তখন তার বাবা মেহের উদ্দিন তাকে নিয়ে চলে যান ভারতের সাধুর দরগায়। সেখানে তার বাবার সঙ্গে সাধুর আশ্রমে বড় হতে থাকেন। ১৯ বছর সাধুর আশ্রমে কাটিয়ে ৩০ বছর বয়সে চলে আসেন গাইবান্ধার নিজ বাড়িতে । তখন তার মাথায় বড় বড় জট পাকানো চুল আর পরনে ছিলো চটের বস্তা। শরীর জুড়ে লোহার বিভিন্ন তালা ও শিকল জড়ানো । 

এ অবস্থায় মা আসমা বেগম তার ছেলেকে চিনতে পেরে বাড়িতে আশ্রয় দেন। গায়ে জড়ানো শিকল ও তালা আর হাতে-পায়ে স্টিলের বালা পরা দেখে এলাকায় হৈ চৈ পড়ে যায় তাকে নিয়ে। দুরদুরন্ত থেকে লোকজন বাড়িতে দেখতে আসেন। এক সময় তার নাম হয়ে যায় তালা বাবা। নিত্য দিনের খাওয়া বলতে রুটি। তিন বেলা তিন রুটিতেই তিনি সন্তুষ্ট। মা ভাবেন এই অবস্থায় ছেলেকে বিয়ে করাতে হবে। তাহলে ছেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তাই বাবা মেহের ভারতে অবস্থান করায় তার অনুপস্থিতিতেই বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে থাকেন মা।

৩২ বছর বয়সে একই এলাকার সাহিদা বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরপরও ঘর সংসার বলতে সাধুর বেশ ছাড়তে পারেনি। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো আর রাতে বাড়ি ফেরা। তারপর একে একে সহিদুল, আমিনা, মমতাজ ও ফাতেমা ৪ সন্তানের বাবা হয়ে যান। বাড়ি ভিটাসহ তিনি ২ বিঘা জমির মালিক। 

২০১৬ সালের কনকনে ঠাণ্ডার দিনে সকাল বেলা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান তালা বাবা। তিনি বর্ডার পার হয়ে চলে যান ভারতের সাধু বাবার আস্তানায়। সেখানে তার বাবার সঙ্গে আবারও দেখা হয়। 

এদিকে স্ত্রী সাহিদা বেগম আর্থিক টানাটানির মধ্যে সন্তানদের বড় করেন। সংসারে ঘানি টানতে তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। এক সময় ছেলে সহিদুল কাজের সন্ধানে চলে যায় ঢাকায়। সেখানে গিয়ে গার্মেন্টস কর্মী হিসাবে কাজ যোগাড় করে নেন। বাবার অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল ধরেন । 

২০১৯ সালে তিনি আবার চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে । কিন্তু বাড়িতেও স্থায়ী হতে পারেননি। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। মাজারে মাজারে, পীরের দরগায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এবছরের শুরুতে তিনি আবার গাইবান্ধায় তার গ্রামের বাড়ি গিদারীতে আসেন । সকালে ১ টা রুটি খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। এ হাট ও হাট ঘুরে রাতে ফেরেন বাড়িতে । এরমধ্যে কেউ রুটি খেতে দিলে মহা খুশি। রুটি খেয়ে পান মুখে দিয়ে খেতে খেতে হেঁটে অথবা ভ্যানে ফিরে চলা । 

গাইবান্ধার কামারজানি সড়কের রেজিয়া মার্কেটের সামনে দেখা পেলাম এই তালা বাবার। ছবি তুললাম। কোন কথা নাই তার মুখে। লোকজন ঘিরে আছে চারপাশে। এর মধ্যে প্রশ্ন করলাম ক্যামন আছেন, আপনি কি করেন? আর গায়ে এসব কি? তিনি ঘাড় নেড়ে তাকিয়ে শুধু বললেন, ছবি তুলেছেন আপনি। আপনার সাথে কোন কথা নাই। 

তার বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী সাহিদা বেগমের কাছে জানলাম- তিনি কখন কোথায় যান, কি খান তা জানা কঠিন। তবে বাড়িতে ভাত খাননা ১৯ বছর ধরে। আগে খেতেন। 

স্ত্রী সাহিদা আরও বলেন, তিনি কারও ক্ষতি করেন না। কম কথা বলেন। ইচ্ছে হলে কথা বলেন ,আর না হলে নাই। 

গাইবান্ধা/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়