ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘আমার চক্ষের সামনে বাবারে গুলি কইরা মারছে’

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১০, ৯ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৫:০২, ৯ ডিসেম্বর ২০২১
‘আমার চক্ষের সামনে বাবারে গুলি কইরা মারছে’

‘আমি তহন খুব ছুডু, বাড়িত বাবার সঙ্গেই ছিলাম। এমুন সময় হঠাৎ কইরাই মানুষের চিল্লাচিল্লি আর দৌড়াদৌড়ি। আমি আর বাবা পইলা খাডের নিচে লুক্কাইয়া পরছিলাম। দেহি বাড়ি ঘরে আগুন লাগাইয়া দিছে। পরে বাবা আমারে নিয়া ঘর থাইক্কা বাইর হয়। কিন্তু মেলিটারিরা বাবারে ধইরালায়। তখন আমিও ভয়ে বাবার হাত ধইরাই রাখছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হইলো না, আমার চক্ষের সামনেই বাবারে গুলি কইরা মারলো, মেলিটারিরা।’

কথাগুলো আর শেষ করতে পারেনি, প্রমোদ চন্দ্র বর্মন (৬৩)। তার আগেই চোখ দুটো জলে ভরে গেল। সেদিনের সেই নিরুপায় হৃদয় ভাঙার গল্প শোনাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। বার বার ভেজা চোখ নিয়ে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিলেন সেই ব্রিজটিতে। যেখান থেকে তার বাবাকে নৃশংসভাবে হত‌্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানী সেনারা।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পূর্বদিকে সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নে নীলগঞ্জ বাজার। বাজারের শেষ মাথায় নরসুন্দা নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজটির অপর পাশেই তাড়াইল উপজেলার সীমানা শুরু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি সেনারা এই ব্রিজ থেকে নিরীহ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলেছিল। আর মৃত লাশগুলো ভেসে ভেসে একসময় অদূরে হারিয়ে যেত। সে সময়ের হত‌্যার শিকার ৮ জনের পরিচয় মিলেছে। তারা সবাই নীলগঞ্জ বেত্রাটি বেপারীপাড়ার জেলেপল্লীর বাসিন্দা ছিল।

আরো পড়ুন:

তাদের একজন মুকুন্দ চন্দ্র বর্মন। তারই ছেলে প্রমোদ। যুদ্ধের সময় তার বয়স ১৩ বছর। পরিবারের সবার ছোট, তাই বাবার খুব প্রিয় সন্তান ছিলেন তিনি। সবসময় বাবার সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করতেন। তাইতো বাবার শেষ স্মৃতিটুকুও তিনিই বুকে গেঁথে রেখেছেন। তবে সেটি সুখের নয়, অনেক কষ্টের। খুব কাছ থেকে বাবাকে নির্মমভাবে হত‌্যা হতে দেখেছেন। সে দিনের সেই রক্তমাখা দিন আজও তাকে কাঁদায়।

তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রথমে আমাদের জেলেপাড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয় হানাদার পাকিস্তানি সেনারা। তখন ভয়ে অনেকেই পালিয়ে বাঁচে। আর যাদেরকে পায়, তাদেরকে ধরে ব্রিজের ওপর নিয়ে আসে। তারা সবাই আমাদেরই বংশের, সম্পর্কে কাকা-জেঠা। ব্রিজের ওপর সবার হাত বেঁধে একে একে রাইফেল দিয়ে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আমি আমার বাবার হত‌্যা খুব কাছ থেকে দেখেছি। গুলির শব্দে আমি ভয়ে দৌড়ে একটি জঙ্গলে গর্তের মধ‌্যে লুকিয়ে বাঁচতে পারি।’

প্রমোদের বড় ভাই প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মন (৭০) রাইজিং বিডিকে বলেন, ‘আগুন দেওয়ার পর সবাই যার যার মত নিজেকে রক্ষা করতে ব‌্যস্ত। কিছুক্ষণ পর আমরা কিছু গুলির শব্দ পাই। কয়েক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, বাবা ও ভাইকে খুঁজতে বের হই। পরে বাড়ির পেছনের ঘন জঙ্গলে গর্তের ভেতর থেকে ছোট ভাইকে উদ্ধার করি। তখন ও ভয়ে জড়োসড়ো ছিল। আর শুধু কাঁদছিল, কিছুই বলতে পারছিল না। পরে ওর মুখেই বাবাকে মেরে ফেলার বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারি।’
এমন নৃশংসতম হত‌্যার বর্ণনা দেওয়াটা অনেক কষ্টের। তবে সেদিনের হ‌ত‌্যার সময় আকস্মিকভাবে বেঁচে যায় একজন। তিনি সুবোধ চন্দ্র বর্মন। বয়স কম থাকায় বুদ্ধিমত্তার কারণে হাতের বাঁধন খুলে নদীতে ঝাপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তারপরই চলে যান ভারতে। বর্তমানে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন।

তবে নীলগঞ্জ বেত্রাটি বেপারীপাড়ায় জেলে পল্লীর এসব মানুষের একটা আক্ষেপ রয়েছে। বিজয়ের ৫০ বছরেও এখানকার এই বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। এমনকি বধ্যভূমিটি সংরক্ষণেরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই তারা এ ব‌্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জোড়ালো দাবি জানিয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আলী সিদ্দীকি রাইজিংবিডিকে জানান, যে সকল বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি, সেগুলোর ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ চলমান। অনেকগুলো নদীর জায়গার ওপর পরেছে,তাই সেগুলো জমি সংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়েছে। আশাকরি নীলগঞ্জের বধ্যভূমিটাও সরকারি ডিজাইনে ভবিষ্যতে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হবে।

কিশোরগঞ্জ/বুলাকী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়