ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

২৫ লাখ টাকা কাল হলো সৌদি প্রবাসীর, বাড়িতে মাতম

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ৩০ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১২:২৮, ৩১ জুলাই ২০২২
২৫ লাখ টাকা কাল হলো সৌদি প্রবাসীর, বাড়িতে মাতম

আরেফিন খান

বছর চারেক আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ সরাইল উপজেলার শাহজাদাপুর গ্রামের আরেফিন খান (৩২)। চেয়েছিলেন ইউরোপ যেতে। এজন্য নিজের কাছে রেখেছিলেন ২০-২৫ লাখ টাকা। এই টাকাই যেন কাল হলো আরেফিনের। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে গত ২ জুন উত্তপ্ত মরুভূমিতে সীমাহীন দুর্ভোগ ও শ্বাসকষ্টে মার যান আরেফিন।

ঘটনার একমাস পর গত ১১ জুলাই পরিবার জানতে পারে আরেফিন আর বেঁচে নেই। এমন খবরে গ্রামজুড়ে চলছে শোকের মাতম। মায়ের একটাই আকুতি, শেষবারের মতো ছেলের লাশ দেখতে চান। লাশ আনতে ইতোমধ্যে জমি বিক্রি করছেন আরেফিনের পিতা আলমগীর খান। 

আরেফিন দেশে আসার কথা ছিল। এজন্য সকল আয়োজনও সম্পন্ন করেছিল। মামা মোরসালিন চৌধুরী জানান, আরেফিনের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় ১ জুলাই। এর মধ্যে মৃত্যুর খবর কফিল বা সহকর্মী কেউ-ই জানাননি। 

ছেলের মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ আরেফিনের মা-বাবা। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পরিবারের সকল স্বপ্ন। নিহত আরেফিনের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, চার ভাইয়ের মধ্যে আরেফিন সবার বড়। পরিবারের সুখের কথা ভেবে ৪ বছর আগে একই গ্রামের ফারুক মিয়ার মাধ্যমে ফ্রি ভিসায় সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানে ভালোই ছিল। প্রতি মাসেই বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। 

একটি সূত্রের খবরে জানা গেছে, আরেফিনের হাতে ২০-২৫ লাখ টাকা জমা ছিল। এমন খবরে সেখানে বাংলাদেশের একটি দুষ্কৃতিকারী দালাল সিন্ডিকেট তার পিছনে লাগে। লোভ দেখায় ইতালির। সেই ফাঁদে পা দেয় আরেফিন। ইউরোপের প্রলোভনে হাতিয়ে নেয় বেশ টাকা। সিন্ডিকেটের হাত ধরে বর্ডার পার হয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেয়। ব্যর্থ হয়ে প্রচণ্ড গরমে উত্তপ্ত মরুভূমিতে আরেফিনকে ফেলে আসে সিন্ডিকেট চক্র। সেখানে সীমাহীন দুর্ভোগ ও কষ্টে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আরেফিন। মৃত্যুর তিন দিন পর আরেফিনের লাশ উদ্ধার করে রাফা সেন্ট্রাল হাসপাতালের হিমাগারে রাখে সেই দেশের পুলিশ। 

সেখানকার মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘মৃত্যুর কারণ অজানা। তবে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্টে মৃত্যু হয়েছে।’ মৃত্যুর খবর সৌদি দূতাবাস, কফিল বা তার কোনও সহকর্মী আরেফিনের পরিবারকে জানায়নি। 

আরেফিনের মামা মোরসালিন জানান, ফোনে নিয়মিত তার সঙ্গে কথা হতো। বেশ কিছুদিন ফোন বন্ধ পাচ্ছিল। তার মাকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনিও বন্ধ পেলেন। মধ্যস্থতাকারী সৌদি প্রবাসী ফারুককে ফোন দিলেন সে জানায়, ‘আরেফিন বর্ডারে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন’। অপেক্ষায় থাকি জামিনের। নিয়মিত দালালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। ফারুকসহ সকলেই বার বার জানায়, জেলখানায় আছে। গত ১০ জুলাই রাতে পরিচিত অ্যাড. সোহেল খাদেমকে প্রথম মৃত্যুর সংবাদ দেয় তার এক স্বজন। পরদিন (১১ জুলাই) আমরা জানতে পারি। 

আরেফিনের একাধিক স্বজন জানান, শাহজাদাপুর গ্রামের তাহের মিয়ার ছেলে ছাদেক (৩৫) আর আরেফিন ক্লাসমেট। সৌদিতে তারা একই রুমে থাকতো। আরেফিনকে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়েছিল ছাদেকের গাড়িতে। খাবার ও পানি যখন শেষ, যন্ত্রণায় নিরুপায় আরেফিন তখন ছাদেকের ফোনে ৭০-৮০ বার কল দেয়। অনেকগুলো ভয়েস ম্যাসেজও পাঠায়। ম্যাসেজে আরেফিন বলেছিল, ‘আমি খুবই কষ্টে আছি। পানি শেষ। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে গেছি। মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। ছাদেক তুমি আমাকে নিয়ে যাও। আমাকে বাঁচাও’। ঘুমের ঘোরে ছাদেক আরেফিনের এসএমএস বুঝতে-শুনতে পারেননি। ঘুম থেকে জেগে ছাদেক রওনা দেয় মরুভূমির দিকে। সেখানে যাওয়ার পরই পুলিশ গাড়িসহ ছাদেককে গ্রেপ্তার করে। ছাদেকের কফিল ছাড়িয়ে এনে তাকেও দেশে পাঠিয়েছেন। ৩/৪ দিন আগে ছাদেক দেশে আসলেও আরেফিনের মা-বাবা বা কোনও স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত করেননি। 

নিহত আরেফিনের মা বিউটি বেগম ও বাবা আলমগীর খান বলেন, আমাদের সব শেষ। এমন সর্বনাশ কে করলো। একই গ্রামের বাসিন্দা হয়েও ফারুক ও ছাদেক কেন মৃত্যুর খবর দিলো না। আমাদের ছেলের টাকা-পয়সা লুটে নিয়ে কৌশলে মেরে ফেলেছে। এর বিচার চাই। ছেলের লাশ দ্রুত দেশে আনতে সরকারের সহায়তাও চান তারা। 

এ বিষয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক মৃদুল বলেন, ঘটনাটি আমাদের জানা নেই। তবে লাশ আনতে কাগজপত্রের যে সহযোগিতার প্রয়োজন, সেটা আমরা করবো।

মাইনুদ্দীন/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়