ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

অবৈধ বালু উত্তোলনের মহোৎসব, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০২, ১০ জুলাই ২০২৪  
অবৈধ বালু উত্তোলনের মহোৎসব, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি

মাদারীপুরের বিভিন্ন নদ-নদীতে অবাধে চলছে বালু উত্তোলন। এতে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীরব থাকছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, মাদারীপুর জেলায় কোনো বালু মহাল নেই। আর তাই বালু উত্তোলন করলেও সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে। যদিও অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে গত তিন মাসে ১৭টি অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। 

সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাদারীপুরে নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে লাখ লাখ ফুট বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী একটি চক্র। কোনোরকম সরকারি ইজারা ছাড়াই প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে কয়েক মাস ধরে চলছে বালু তোলার মহোৎসব। মাদারীপুর, কালকিনি, রাজৈর, ডাসার ও শিবচর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও পদ্মা নদী থেকে ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বালু তোলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা অবৈধভাবে কাজটি করে যাচ্ছেন। এতে পানির প্রবাহে গতি পরিবর্তন হওয়ায় নদীর পাড় ভেঙে এলাকার ফসলি জমিসহ বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। তবে বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না।

সরেজমিনে গিয়ে আরও দেখা যায়, নদীর মাঝখানে ও কূল ঘেঁষে কয়েকটি ড্রেজার মেশিন বসানো। এর প্রতিটি মেশিনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়েকটি বাল্কহেড। প্রতিটি বোটে ১০-১২ জন লোকের পাহারা। মাদারীপুর সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের একাধিক গ্রামবাসী বালু উত্তোলনের কারণে দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, এই অবৈধ বালু উত্তোলন আমাদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। আমাদের গ্রাম নদী গ্রাস করে নিচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, আমাদের জমি জিরাত বালু উত্তোলনের ফলে ভেঙে যাচ্ছে। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের জীবনটা বাঁচব। 

চর হোগলপাতিয়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা কাজী ইলিয়াস আকন বলেন, নদীটা অনেক দূরে ছিল। আমরা নদীর অনেক দূরে গিয়ে গবাদি পশু গোসল করতাম। ড্রেজারে বালু তোলার ফলে ধীরে ধীরে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রায় আধা মাইল পর্যন্ত চলে এসেছে। এখন হুমকির মুখে আমাদের কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। 

মাহফুজ নামে এক ব্যক্তি বলেন, প্রতিদিন একটু একটু করে পাড় ভেঙে যাচ্ছে। মূলত অবাধে বালু তোলার কারণে সব সময় আতঙ্কে থাকি। কখন জানি আমাদের বাড়িঘর পানিতে চলে যায়। প্রভাবশালী চক্রটি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবাধে বালু উত্তোলন করছে। 

নদীর কবলে ৮ বার বসতভিটা বিলীন হওয়া হোসেনাবাদ গ্রামের আরেক কৃষক সিরাজুল মাতুব্বর জানান, বালু উত্তোলনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি ও বিস্তীর্ণ এলাকা। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবাধে বালু উত্তোলন করছে ওই চক্রটি। তাদের ভয়ে অনেকে মুখ খুলে কিছু বলতে পারছে না। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি।

৬০ বছরের বৃদ্ধা রোকেয়া বেগম আক্ষেপ নিয়ে বলেন, নদীর পারে আমার বাবা-মায়ের কবর ছিলো। বালি কাটার কারণে  সেই কবরও ভেঙে গেছে। বাধা দিতে গেলে আমাদের মারতে আসে। তারা অনেক ক্ষমতাশালী লোক। এই বালি কাটার কারণে আমাদের ঘর কয়েকবার ভাঙছে। এখন পরের জমিতে ঘর তুলে থাকি। 

মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল সাত্তার ফকির বলেন, আমরা নদীভাঙন এলাকার লোক। ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু কাটার কারণে আমাদের বসতঘর দুইবার নদীতে ভেঙেছে। যারা বালি কাটে তাদের অনেক ক্ষমতা। আমরা তাদের ভয়ে কিছু বলতে পারি না। 

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত বালু উত্তোলনকারী ফারুক সরদার, মজিবর খা, শফিক মাতুব্বর, দেলোয়ার মুন্সিসহ একাধিক বালু উত্তোলনকারী অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা দাবী করেন সরকারী উন্নয়ন কাজের জন্য সামান্য বালু তোলা হয়। বালু না তুললে সরকারী উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে যাবে বলে দাবী তাদের। তাই এই বালু উত্তোলনকে তারা অবৈধ মানতে নারাজ। 

আলীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ পারভেজ বলেন, যারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে  মানুষের ঘরবাড়ি বিলীন, ফসলের জমি নষ্ট করছেন তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের জোড় দাবি জানাচ্ছি। 

ঝাউদি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আবুল হাওলাদার বলেন, অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে। আমি বিষয়টি প্রশাসনকে অবগত করেছিলাম। 

কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম দাস বলেন, যারা এই অবৈধ বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। যারা প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে বালু উত্তোলন সুবিধা নিতে চায় তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা একেবারেই নিষিদ্ধ। 

মাদারীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল মামুন বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। বালু উত্তোলনকারীরা আসলে আমাদের কথা বলে সুবিধা নিতে চায়। বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ 

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, যারা অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করেন তাদের ব্যাপারে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই অভিযান চলছে। তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হচ্ছে।

/ইমন/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়