ঢাকা     বুধবার   ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৩ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বৃষ্টি, নীলা আর কিছু না বলা শব্দ-স্মৃতি

ফাতিহা নাফসি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ২০:১৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
বৃষ্টি, নীলা আর কিছু না বলা শব্দ-স্মৃতি

ফাতিহা নাফসি।

১৩ ভাদ্র
মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে, যখন কিছু মুহূর্তের কোনো ভাষা থাকে না, কোনো গল্প থাকে না; তারা শুধু নীরব স্মৃতির কুয়াশায় আড়ালে থাকে। নিঃশব্দ, অথচ অনন্ত। 

নীলা; নামের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে এক নীল শান্তি, এক মৃদু ঢেউয়ের ছোঁয়া। মেয়েটি নরম, শান্ত স্বভাবের। চোখে চোখ রেখে কথা বলা তার কাছে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। ছোট ছোট বাধা পেরিয়ে, আপাত সাধারণ কিছু স্বপ্ন নিয়েই তার পথচলা। জীবনের এই নতুন অধ্যায় শুরুর আগে কত শখ, কত রঙিন কল্পনা ছিল! অথচ অজানা এক অনীহা, এক গভীর দুশ্চিন্তা তাকে ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দ করে রেখেছিল। মনে হতো; জীবনটা হয়তো এমনই হবে; একঘেয়ে, নিরাসক্ত, নিস্তরঙ্গ।

আরো পড়ুন:

কিন্তু, কে জানত, এই নিস্তরঙ্গতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক চঞ্চল, আবেগময় গল্পের সূচনা! সেদিন আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। বাতাসে ভাসছে নতুন বৃষ্টির ঘ্রাণ। বাবা খবরের কাগজে বুদ। হঠাৎ বললেন,
“মা, এক কাপ চা করে নিয়ে আয় তো।”

বিকেলটা ছিল একদম সাধারণ। তবু মনে হচ্ছিল, কোথাও যেন অচেনা এক সুর বাজছে। হঠাৎ করেই আমি বলে ফেললাম, “আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।” নতুন শহরের কথা মনে হতেই বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি উঠল। মন চাইছিল না, তবু যেতেই হলো। এক অদৃশ্য টান আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অজানার পথে। নিজেকে বোঝালাম—যেতে হবে—হয়তো জীবন সেখানেই নতুন কিছু লিখে রাখবে।
নতুন শহরে এসে প্রথমেই টের পেলাম; এই শহরের শীতটা অন্যরকম। নতুন মুখ, নতুন ভাষা, নতুন ঢঙে কথা বলা—সবকিছুই যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। প্রথমে ভয় লাগলেও, কিছু দিনের মধ্যেই সবাই চেনা হয়ে যায়।

তারপর একদিন; ভিড়ের মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল এক অচেনা মুখ। মনে হলো, কোথাও যেন আগে দেখা। চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আলোড়ন। মনে হলো, সে আমাকে দেখছে;  নীরবে, অজান্তে। আমি মনকে শক্ত করে উপেক্ষা করলাম, কিন্তু, সেই দৃষ্টি যেন ভেতরে কোথাও থেমে রইল।
এরপরের দিনগুলোতে নীলা বদলে যেতে লাগল। হালকা আকাশী রঙ যেন তার ভেতরের নীল মায়াকে জাগিয়ে তুলল। সেই মায়ার মধ্যেই জন্ম নিতে লাগল এক গল্প; নীলার মোহের গল্প।

তারপর হঠাৎ যেন কেউ ছিঁড়ে ফেলল সেই গল্পের শেষ পৃষ্ঠা। কলম থেমে গেল, থেমে গেল সময়। বহু বছর পর একদিন বৃষ্টির ঘ্রাণে আবার ফিরে এলো সেই হারানো স্মৃতি। সেই আকাশী রঙ আবার চোখে ভাসল।

বৃষ্টি পড়ছে; নীরব, নিরন্তর। নীলা হাঁটছে অজানা পথে। চোখেমুখে পুরনো ক্লান্তির ছাপ, ঠোঁটের কোণে অনুচ্চারিত কিছু কথা; যেগুলো আজও বাচন রঙ খুঁজে পায়নি। বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাচ্ছে সময়। তবু কিছু স্মৃতি থেকে যায়; অমলিন, অব্যক্ত, অথচ অবিশ্বাস্য সুন্দর।

২৫ ভাদ্র
নতুন শহরটা নীলার কাছে ধীরে ধীরে আপন হয়ে উঠছিল। কিন্তু, তার মনের গভীরে যে অচেনা আলোড়ন জন্ম নিয়েছে, তার ব্যাখ্যা সে নিজেও খুঁজে পায় না। সবই তো স্বাভাবিক। নতুন কর্মক্ষেত্র, নতুন রাস্তাঘাট, নতুন বন্ধুত্ব। তবু, কোথাও যেন এক অদৃশ্য স্রোত তাকে টেনে নিচ্ছিল অন্য কোনো পথে; যেখানে যাওয়ার কথা সে কোনো দিন ভাবেনি।

সবকিছুর শুরু সেই দৃষ্টি থেকে। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ যে অচেনা চোখে তার চোখ আটকে যায়। চোখ তো প্রতিদিনই কারও না কারও সঙ্গে মেলে। কিন্তু, ওই চোথে ছিল এক নীরব প্রশ্ন। এক অদ্ভুত উষ্ণতা। নীলার শান্ত, নিয়ম মাফিক জীবনে তা এনে দিয়েছিল নতুন ছন্দ।

সেদিনের বিকেলটা ছিল হালকা সোনালি। ক্লাস শেষে নীলা ক্যাম্পাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাতাস নিচ্ছিল। হঠাৎ বুঝল, কেউ এগিয়ে আসছে। ‘এটা কি আপনার?’ নরম কণ্ঠস্বর। নীলা তাকিয়ে দেখে, সেই চোখ। এক মুহূর্তের জন্য সময় থমকে গেল। কলমটা হাতে নিল সে। কিন্তু, আর কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।

এই দুটো শব্দ বলেই নীলার বুকের ভেতরের অজানা সংকোচ একটু ঢিলে হলো। ধীরে ধীরে নীলার চারপাশে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হতে লাগল। কিন্তু, তার উপস্থিতি ছিল আলাদা। সে কখনো বিরক্তিকর ভাবে তাকাত না। কখনো জোর করত না। বরং, দূর থেকেই নীরবে পর্যবেক্ষণ করত। যেন বলছে, ‘তোমাকে খুঁজছি, কিন্তু, তাড়া করছি না’। এই নীরবতা, এই সংযম অদ্ভুতভাবে নীলার ভেতরে জায়গা করে নিতে লাগল।

তারপর এলো সেই দিন। আকাশ ছিল ধূসর। অর্ধেক শহর রঙ হারিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায় ঝিমিয়ে আছে। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে নীলা বুঝল, বৃষ্টি নামবেই। আজ ছাতা আনেনি সে। দৃশ্যটা যেন কোথাও আগে দেখা—কোনো পুরনো স্মৃতি, কোনো গল্প, অথবা অজানা অনুভূতি। কিন্তু কোথায়, মনে করতে পারল না।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ, ‘কবে আসবি? তোর ট্রেনের টিকিট করে রেখেছি’। নীলা চুপ করে গেল। মনে হলো—এই শহরে সে আসলে কতটুকু আটকে গেছে! কারও কাছে, নাকি কোনো অনুভূতির কাছে! বাইরে বেরিয়ে পড়ল। চা খেতে ইচ্ছে করছিল। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে চারপাশ ভিজে যাচ্ছে। নীলার মনে হচ্ছিল, এই শব্দের ভেতরে আরও এক ধরনের শব্দ লুকানো—নরম, ধীর, অদৃশ্য। যেন দু’জন মানুষ নয়, একটা গল্প পাশাপাশি হাঁটছে।

নীলা বুঝতে পারল, তার ভেতরে কিছু একটা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে; যা এতদিন সে নিজেই লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু, সে জানত না এটা কেবল শুরু, শেষ নয়। কারণ যে গল্প নীরবতায় জন্ম নেয়, তার শেষ কখনো শব্দে হয় না।

কোনো হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যায়, অথবা অঝোর বৃষ্টিতে; একটি নামহীন স্মৃতির মতো। হঠাৎ এক বিকট শব্দে নীলার ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসে পড়ল সে। তারপর একগাল হেসে দরজা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দে পুরনো সব স্মৃতি জেগে উঠছে। যেসব গল্প এতদিন শুধু সাহিত্যে পড়েছে; সেসব গল্প কি কেবল স্বপ্নেই সত্যি হয়!

২৮ ভাদ্র
সকালের আলো আজ নীলার ঘরে ঢুকছিল অন্যভাবে; হালকা, কোমল, অথচ তাতে লুকিয়ে ছিল এক অচেনা শীতলতা। বিছানায় উঠে বসতেই মনে হলো, কাল রাতে সে কিছু একটা স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নটা পুরো মনে নেই। সবই যেনো ঝাপসা।

লেখক: শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা/জান্নাত

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়