ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আন্দোলনের সময় প্রতিটা মেসে খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়

বিজয় ধর, রাঙামাটি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৯, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৫:২১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
আন্দোলনের সময় প্রতিটা মেসে খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়

তাহসিন কবির

আন্দোলনের সময় ক্যাম্পাসের প্রতিটা মেসে রাতের খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি স্থানীয় হোটেলগুলোতে নিষেধ করা হয় সুইডিশের কোন ছাত্রকে যাতে খাবার না দেওয়া হয়। বলেন, মো. তাহসিন কবির।

রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ৬ষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি আহত হন। ১৭ জুলাই কাপ্তাই নতুন বাজারে তিনি বেদম মারধরের শিকার হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখতে পান।

আরো পড়ুন:

তাহসিন কবিরের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার দক্ষিণ খরখরিয়ার তেলিপাড়ায়। 

আলাপকালে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাতে আহত হওয়া মো. তাহসিন কবির আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন।

তাহসিন কবির বলেন, “সুইডিশে আমাদের আন্দোলন শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর দিক থেকে। বাংলাদেশ-সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আমরা প্রথম থেকে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে আসছিলাম। মূলত আমাদের আন্দোলনটা বেগবান হয় ১৫ জুলাই থেকে, যখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদেরকে মারধর করে বের করে দেওয়া হচ্ছে। ঐদিন ১৫ জুলাই রাতেই আমরা ক্যাম্পাসের সবাই আন্দোলনে নেমে যাই। সারারাত ব্যাপী আমরা ক্যাম্পাসে আন্দোলন করি এবং পরের দিন আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। ১৬ জুলাই সকাল ১০ টায় আমাদের কর্মসূচী ছিল কিন্তু আন্দোলনে নামার আগে পুলিশ আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে। বাহিরে অবস্থানরত  বিভিন্ন ছাত্রদের ক্যম্পাসে আসতে বাধা দেয়।  আমরা সব ছাত্ররা একত্রিত হতে পারছিলাম না।” 

তাহসিন বলেন, “এটা পার্বত্য জেলা হওয়ায় এখানে সেভাবে মুভমন্টে করাও যাচ্ছিল না। এরপরেও আন্দোলন চালিয়ে যাই। ১৬ জুলাই বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে খবর পাই আমাদের ছাত্ররা যারা আন্দেলনে অংশ নিতে ক্যাম্পাসে আসতে চাচ্ছিল, ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং পুলিশ  তাদেরকে মেরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। এদিকে আমাদের ক্যাম্পাসে মুল ফটক তালাবদ্ধ ছিল তাই আমরা ক্যম্পাসের বাইরেও যেতে পারছিলাম না। আমাদের অনেক ছোট ভাই ফোন করে বলছিলো, ভাই আমাদেরকে মারছে আমাদের বাঁচান। তখন আমরা বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাসের গেইটের তালা ভেঙে বের হয়ে যাই। পরে পুলিশ বাধা দেয় কিন্তু আমাদের আটকাতে পারেনি। আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পর ছাত্রলীগ-যুবলীগ হামলা করে আমাদের উপর। তাদের বাধায় আমরা আবারও ক্যাম্পাসে ফেরত আসি। এরপর আবারও আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করি। এর কিছুক্ষণ পর আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাজারের দিকে মিছিল নিয়ে এগুতে থাকি।ওদের সাথে আমাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর পুলিশ আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।পরে আমরা ঐখান থেকে চলে আসি।”

তাহসিন কবির বলেন, “১৬ জুলাই রাত ২ টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে নোটিশ দেওয়া হয় ১৭ জুলাই সকাল ৭ টার মধ্যে হোস্টেল ছাড়তে হবে। আশেপাশে থাকব সেরকম কোন পরিস্থিতি ছিল না, এখানে আন্দোলনরত বেশিরভাগই ছাত্রই এখানকার স্থানীয় না।তাই বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাস থেকে রাতের মধ্যে পালিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ নিজ ক্যাম্পাস থেকে নিজেকে রাতের অন্ধকারে পালাতে হয়েছে।” 
  
“কাপ্তাই নতুন বাজারে আমাদের ছাত্রদের কয়েকটা মেস আছে, ১৭ জুলাই সেখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ মেসে ঢুকে ছাত্রদেরকে বেধড়ক মারছিল। আমি যখন জানতে পারি সাথে সাথে বাজারে চলে যাই। আমার  সাথে কয়েকজন প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। ওখানে যাওয়ার পর দেখলাম ৩০-৪০ জন ছাত্রলীগের ছেলেরা অবস্থান করছে” বলেন, তাহসিন কবির।

তাহসিন বলেন, “আমার হাতে তখন আত্মরক্ষার জন্য একটা রড ছিল। ওদের হাতে ছিল বিভিন্নরকম অস্ত্র । আমি কোন মতে ওদের কাছে  থেকে পালিয়ে আসতে চাইলেও ওখান থেকে আর বের হয়ে আসতে পারিনি। ওরা আমাকে পাথর এবং লাঠিসোঠা দিয়ে আঘাত করে।ওদের পাথর ও লাঠির আঘাতে আমার পেটে বুকে এবং কোমরে মারাত্মকভাবে আঘাত পাই। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমার জ্ঞান আসে রাত সাড়ে ৮টা বাজে। আমি দেখতে পাই আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি আহত হওয়ার আন্দেলনরত ছাত্ররা আমাকে প্রথমে হোস্টেলে এরপরে কাপ্তাইয়ের বড়ইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার আমাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে।

চট্টগ্রামে মেডিকেলের কর্তব্যরত ডাক্তাররা প্রথমে ৫ দিনের জন্য ভর্তি থাকতে হবে বললেও পরবর্তীতে এত পরিমাণ রোগী আসতে শুরু করেছিল, মেডিকেলের পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল।  তারপর ওখানেও আমাকে রাখা সম্ভব হয়নি।পরবর্তীতে আমার পরিবার এবং আমার মামারা চট্টগ্রামের পটিয়ায় আমার নানুর বাসায় নিয়ে যায়।” 

তাহসিন বলেন, “আমি শুনেছিলাম অ্যাম্বুলেন্সে যখন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য  চট্টগ্রামে মেডিকেল গেইট দিয়ে প্রবেশ করছিল তখনও বাধা দেওয়া হয়। তিনি বলেন,পরবর্তীতে আমি ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করায়। তিনি বলেন, মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসার ব্যয় প্রথমে বন্ধু-বান্ধবরা বহন করেছে। পরবর্তীতে বাড়ি থেকে আমার পরিবার আসার পর তারা সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করেন।”

তাহসিন কবির বলেন, “সুস্থ হওয়ার পর কাপ্তাই আসতে না পারলেও যে যার যার অবস্থান থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। তখন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আলাদাভাবে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু কাপ্তাই আসা হয়নি। ৫ আগস্ট যখন স্বৈরাচারের পতন হয় এরপর যখন ক্যাম্পাসে আসি তখন থেকে বৈষম্যবিরোধী সকল আন্দোলনে যুক্ত রয়েছি।”

তাহসিন কবির বলেন, “স্বৈরাচারের পতন হয়েছে এটাতো একটা আনন্দের ব্যাপার। আমরা যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা আছি পুরো দেশটাকে সবক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্ত করতে হবে। দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।” 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, “কিছু রাজনৈতিক দল বা তৃতীয় পক্ষ আমাদের আন্দোলনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। আমাদের আন্দোলনকে নষ্ট করার জন্য অনেকে চেষ্টা করছে। আমরা চাই আন্দোলনকে যেভাবে সফল করেছি সেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একটি বৈষম্যমুক্ত ও স্বৈরাচারমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে হবে সকলকে।”

ঢাকা/টিপু

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়