চিলেকোঠার সেপাই: শ্রমজীবী মানুষের আখ্যান
নাজমুল হাসান অনিক || রাইজিংবিডি.কম
চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের পটভূমিতে লেখা। বাংলাদেশের সাহিত্যে যে কয়টি আলোচিত উপন্যাস রয়েছে, এটাও তার মধ্যে অন্যতম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার নিজস্ব ভাষাশৈলী দিয়ে এমনভাবে উপন্যাসটি ফুটিয়ে তুলেছেন, যা আজও পাঠকের মনে দাগ কেটে যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে যে আন্দোলনটি মুক্তিযুদ্ধের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে উনসত্তরের এই গণ অভ্যুত্থান। দেশ তখন নেতাবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। বামপন্থী নেতারা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। ছাত্ররা দেয় তাদের মুক্তির ১১ দফা। তাদের মতে আওয়ামী লীগের ৬ দফা এই ১১ দফার মধ্যেই বিরাজমান। সেই মুহূর্ত থেকে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা শুরু হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সঙ্গীরা জেল খেটেছে। নেতাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ছাত্র, মজুর, মুটে, কুলি, শ্রমিক সবাই নেমে পড়ে রাজপথে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। আর গভর্নর ছিলেন মোনায়েম খান। তারা চালায় পূর্ব পাকিস্তানে তাদের তান্ডব। মিছিল, মিটিং পণ্ড করে দেয়। আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ চলে প্রতিনিয়ত। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে চলে প্রতিবাদ। কারফিউ জারি করে এদেশের বিক্ষোভকারী জনতাকে আটকে রাখার প্রচেষ্টা পশ্চিমাদের অব্যাহত থাকে। তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় শুধু এই স্লোগানই চলছে-
‘সার্জেন্ট জহুরের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না। গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ। জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনব’।
এই উপন্যাসের মূল চরিত্র ওসমান গনি। সামান্য এক সরকারি চাকরিজীবী সে। পুরান ঢাকার এক বাড়ির চিলেকোঠার ছোট্ট এক ঘরে তার বসবাস। তার পরিবার রায়টের পরে পাকিস্তানে এসে পড়লেও তার বাবা আবার ইন্ডিয়ায় চলে যায়। কিন্তু সে এখানে থেকে যায়। দেশের এই আন্দোলনের সময় সে টুকটাক মিছিল মিটিং, সমাবেশে যায়। তার কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে আলোচনা করে। কিন্তু সক্রিয় ভূমিকা তার তেমন থাকে না। সে সময়কার ঢাকা শহরের অবস্থা যদি তার জবানীতে বলতে হয় তাহলে এভাবে বলতে হয়-
‘উত্তর থেকে আসে বরফ গলা শহরের স্রোত, উপচে ওঠে মানুষ গড়িয়ে পড়ছে পাশের গলিতে, উপগলিতে। গলি, উপগলি ভরা শুধু মানুষ, দুই পাশের বাড়িগুলোর ছাদ পর্যন্ত মানুষ। গলি, উপগলি থেকে স্রোত এসে মেশে মূলধারার সঙ্গে। মানুষ বাড়ে, নবাবপুর সামলাতে পারে না। মানুষের প্রবাহ ফের গড়িয়ে পড়ে পাশের ফাঁকা গলিতে।’
আরেকটি চরিত্র পাব আমরা আনোয়ার। যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত। সে চলে যায় তার গ্রামে মানুষের মধ্যে বিপ্লব জাগানোর জন্য। সেখানে গিয়ে দেখে গ্রামের মানুষের উপর চলছে মহাজন, জোতদার খয়বার গাজীর অত্যাচার। সেখানে সে খুঁজে পায় কিছু সাহসী ছেলেকে, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রস্তুত। সবাইকে সাথে নিয়ে যে গ্রামের মানুষের অত্যাচার দূর করার প্রচেষ্টা চালায়। শ্রেণীবিভাজন দূর করার জন্য লড়ে যায়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র এই উপন্যাসে যে সে হচ্ছে হাড্ডি খিজির।
মহাজনের ভাগিনার রিক্সা গ্যারেজের দায়িত্বে আছে সে। রিক্সা চালায়। তার মধ্যে ফুটে ওঠে সে সময়কার মেহনতি মানুষের রূপ। দেশের সংকটের মুহূর্তে এই মেহনতি মানুষরাই দেশের বিপদে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাড্ডি খিজির হচ্ছে তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। মিলিটারির গুলির মুখে সে বুক পেতে দেয়। প্রতিবাদের ঝড় তোলে তার মেহনতি বুকে। উপন্যাসে তার ভূমিকাটাই শেষে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু আমাদের সেই ওসমানের কী হল? শেষ পর্যন্ত ওসমান পাগল হয়ে যায়। প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার মাথায় শুধু উল্টাপাল্টা চিন্তা ঘুরতে থাকে। স্বপ্ন দেখে। তাকে কে যেন ডাকে। একদিন সে সব শেকল ভেঙে বের হয়ে আসে তার সেই চিলেকোঠা থেকে। দেশপ্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেয় রাস্তায়। পুরান ঢাকার সেই অলি গলির কেউই তখন আর ওসমানকে চেনে না। কিন্তু সেই আমাদের চিলেকোঠার সেপাই।
পর্যালোচক: বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (৩য় বর্ষ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
গোপালগঞ্জ/মাহি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন