ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অথচ তাকে সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল

রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১২:১৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
অথচ তাকে সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। বিতর্ক সংক্রান্ত একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে দশম শ্রেণি পড়ুয়া রানাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেইসঙ্গে বিতর্ক, লেখালেখি, ক্লাবসহ স্কুলের সব কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস থেকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারপরই নানা অর্জন নিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ান তিনি।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় প্রকাশিত হয় রানার লেখা। সংবর্ধনা পান তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের হাত থেকে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমন্ত্রিত বিতার্কিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন একটি রেডিও বিতর্কে। সম্প্রতি অর্জন করেছেন ‘আমার বঙ্গবন্ধু লেখক সম্মাননা’। একই বইয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্বের লেখার পাশে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে কথা বলেছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তারুণ্যের অনুপ্রেরণায় পরিণত হওয়া বিতার্কিক রানা হাঁটছেন ভিন্ন পথে।

নিজেকে একজন তরুণ লেখক, বক্তা ও সংগঠক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোদ করেন তিনি৷ পুরো নাম রানা সরকার মহসিন। তবে রানা নামেই অধিক পরিচিত। গাজীপুরের কালীগঞ্জে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাচ্চু সরকার ও মাসুদ বেগমের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। বর্তমানে পড়াশোনা করেছেন ঢাকার আমিরজান কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। এর আগে এসএসসি করেছেন তুমিলিয়া বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।

ছোট থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসে ছিল তার বিচরণ। বিতর্ক, পাবলিক স্পিকিং, আবৃত্তি, বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন, গণিত প্রতিযোগিতা, কুইজ কম্পিটিশনসহ সব শাখায় ছিল তার দক্ষতা এবং নানা পুরস্কার। পাশাপাশি স্কুলের বিভিন্ন ক্লাবেও ছিল তার দক্ষ নেতৃত্ব। শুধু কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস নয় পড়াশোনায়ও মেধাবী রানা৷ প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা ৮ বছর সে ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল, বরাবরই বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হতেন রানা ৷ জেএসসি পরীক্ষায় পেয়েছিলেন বৃত্তি এবং উপজেলার মেধা তালিকায় (ছেলে) ছিলেন চতুর্থ৷

রানার স্কুল শিক্ষক জেরী মার্টিন গমেজ বলেন, রানা আমার ভীষণ প্রিয় একজন ছাত্র। আমার হাতেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে তার বিতর্কের হাতেখড়ি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন সে দশম শ্রেণি পড়ুয়া বিতার্কিকদের টিমে জেলা পর্যায়ে বিতর্ক করেছে এবং জেলায় রানারআপ হয়েছে। তার মতো এমন চমৎকার বিতার্কিক আমি দেখিনি। এখন প্রায় খবরের কাগজে রানাকে নিয়ে লেখালেখি দেখি, যা আমাদের জন্য ভীষণ আনন্দের এবং গর্বের।

বিতর্ক ও লেখালেখিতে পটু এই মেধাবীর রয়েছে নানা অর্জন। একটানা তিন বছর ছিলেন মাধ্যমিক পর্যায়ে উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক, ২০১৬ (জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ), ২০১৭ (মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা), ২০১৮ (জাতীয় উন্নয়ন মেলা বিতর্ক প্রতিযোগিতা), এছাড়াও জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা, শিশুদের মৌসুমি প্রতিযোগিতাসহ নানা জাতীয় প্রতিযোগিতায় রয়েছে তার পুরস্কার। ২০১৭ সালে অর্জন করেছিলেন ভাওয়াল বক্তৃতা প্রতিযোগিতার নির্ধারিত এবং উপস্থিত দুই বক্তৃতার চ্যাম্পিয়নের মুকুট৷ শুধু বক্তৃতা কিংবা বিতর্ক নয় লেখালেখি, আর্ট, কুইজ, গণিত, বিজ্ঞান, আবৃত্তিসহ নানা শাখায় রয়েছে উপজেলা, জেলাসহ নানা পর্যায়ের শতাধিক পুরস্কার৷

এসবের পাশাপাশি একজন দক্ষ সংগঠক রানা৷ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কার্যকরী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বিতর্ক সংগঠন এনডিএফ বিডিতে, দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন কালেরকণ্ঠ শুভসংঘের কালীগঞ্জ শাখায়৷ পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে তরুণদের নিয়ে মাদক, বাল্যবিবাহ, পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনসহ নানা সামাজিক কর্মাকাণ্ড পরিচালনা করে বেশ সমাদৃত হচ্ছেন এই তরুণ।

আমিরজান কলেজের চেয়ারম্যান ও নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান বলেন, সম্প্রতি রানা যেসব পুরস্কার অর্জন করছে, তা চোখে পড়ার মতো এবং আমাদের কলেজকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করছে সে। যা আমাদের জন্য ভীষণ গর্বের। নিঃসন্দেহে তার মতো তরুণদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

আমিরজান কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হাসিনা আক্তার নুপুর বলেন, এই অল্প বয়সেই আমাদের রানার যে অর্জন, তা তরুণদের জন্য সত্যিই অনুপ্রেরণার। চারদিকে যখন নেশা, হতাশা, গেম আসক্তি, তখন রানা হাঁটছে ভিন্ন পথে।

স্কুল ম্যাগাজিনে লেখালেখির হাতেখড়ি। তারপর রচনা প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকবার উপজেলায় সেরা এবং জেলা পর্যায়ে সেরার পুরস্কার পান। সেখান থেকেই মূলত লেখালেখির অনুপ্রেরণা। সম্প্রতি অর্জন করেছেন, আমার বঙ্গবন্ধু লেখক সম্মাননা এর আগে ২০১৯ সালে অর্জন করেছেন আমার বিজয়ের গল্প লেখক সম্মাননা। জাপান, ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশের জনপ্রিয় অনলাইন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কিছু ছোট গল্প। পাশাপাশি লেখালেখি করছেন বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং জাতীয় দৈনিকে। ২০২২ বইমেলায় একটি নতুন বই আসছে বলেও জানিয়েছেন এই তরুণ। এছাড়াও যুক্ত আছেন দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম রবি টেন মিনিট স্কুলের ক্রিয়েটিভ রাইটার বিভাগে।

বিতর্ক করেছেন বিভিন্ন জাতীয় বিতর্ক উৎসব, আন্তর্জাতিক বিতর্ক উৎসব, রেডিও বিতর্কসহ নানা প্ল্যাটফর্মে। পাশাপাশি বিতর্ক সংগঠক হিসেবেও দেশব্যাপী পরিচিত তিনি। অর্জন করেছেন এনডিএফ বিডি ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট অর্গানাইজার অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। আমন্ত্রিত প্রশিক্ষক হিসেবে বিতর্কের সেশন নিয়েছেন স্নাতক পড়ুয়াদের। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজে নিয়েছেন বিতর্কের ক্লাস৷

সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে রানা বলেন, এক সময় ক্লাস টপার ছিলাম, তখন আমার অনেক বন্ধু ছিল, কিন্তু তারপর যখন স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হলাম আমার পাশে কেউ ছিল না। হতাশা আমাকে চিঁড়ে খাচ্ছিল, নিজেকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শেষ মানুষ। তারপর কাছের বন্ধু নুসরাত জাহান লুবনা আর একজন স্থানীয় সাংবাদিক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) আমার পাশে ছিলেন। পরিবারের বাইরে তারা আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যেই ফেব্রয়ারিতে আমাকে বিতর্ক, লেখালেখি থেকে নিষিদ্ধ করেছে, এর পরের ফ্রেব্রুয়ারিতেই আমার লেখা প্রকাশ হয় বই মেলায়, তার পরের ফেব্রুয়ারিতে বিতর্ক করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছি একটি রেডিও চ্যানেলে।

যে বছর আমাকে স্কুলের ডিবেট ক্লাব সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়, তার পরের বছর বিতর্ক শেখানোর আমন্ত্রণ পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি বিশ্বাস করি এই অস্থায়ী পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, সুতরাং জীবনের খারাপ সময়গুলোও অস্থায়ী। মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেলে একদিন সুদিন ফিরবেই।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে রানা বলেন, একজন আইনবিদ হতে চাই, শুদ্ধ আইনকানুন জেনে সমাজটাকে শুদ্ধ করতে চাই। নিজের ব্যর্থতার গল্পগুলোকে অনুপ্রেরণার গল্পে রূপ দিতে চাই, তরুণদের উন্নয়নে কাজ করতে চাই আজীবন।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়