ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

লবণ ছাড়াই কম খরচে চামড়া সংরক্ষণে রাবির গবেষকদের সাফল্য

ফাহমিদুর রহমান ফাহিম, রাবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৯, ২৪ জুন ২০২৫  
লবণ ছাড়াই কম খরচে চামড়া সংরক্ষণে রাবির গবেষকদের সাফল্য

রাবির ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম এবং একই বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. নাদিম হাসান।

সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ পশুর চামড়া নষ্ট হয়। এ বছরও কুরবানি ঈদের পর রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে পশুর চামড়া।

এ সমস্যা সমাধানে পশুর চামড়া সংরক্ষণে যুগান্তকারী, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব এক পদ্ধতি ব্যবহার উপযোগী করে তুলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গবেষকরা।

আরো পড়ুন:

এই নতুন পদ্ধতিতে লবণের পরিবর্তে পার-এসিটিক এসিড (PAA) ব্যবহার করে চামড়া এক মাসেরও বেশি সময় সংরক্ষণ করা সম্ভব। এতে শ্রমিকের প্রয়োজন কম হয় এবং খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

এর প্রধান গবেষক হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম, যিনি বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে রাবির ফলিত রসায়ন বিভাগের রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। সহ-গবেষক হিসেবে ছিলেন, বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. নাদিম হাসান।

গবেষণাটি আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘সল্ট ফ্রি প্রিজারভেশন অফ অ্যানিম্যাল স্কিন: এন ইকো-ফ্রেন্ডলি অ্যাপ্রোস’ শিরোনামে জমা দেওয়া হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, পরিবেশে লবণজনিত দূষণ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে চামড়া সংরক্ষণের কার্যকর উপায় নির্ধারণ।

গবেষকরা জানান, পার-এসিটিক এসিড একটি শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ারোধী পদার্থ, যা চামড়ার চর্বি, অর্গানিক ম্যাটার ও ময়লা দূর করে ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করে। এতে ট্যানিংয়ের সময় চামড়ার মধ্যে বেশি পরিমাণে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করতে পারে এবং কোলাজেন প্রোটিনের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। ফলে তুলনামূলকভাবে কম ক্রোমিয়াম ব্যবহার করেও কার্যকর ট্যানিং সম্ভব হয় এবং চামড়ার গুণগত মানও উন্নত হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে ১১ গুণ কম ক্রোমিয়াম পরিবেশে নির্গত হয়, যা পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। পাশাপাশি, পার-এসিটিক এসিড ব্যবহারে সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকছে না এবং ট্যানিং সময় পরিবেশে কম পরিমাণে ক্রোমিয়াম নির্গত হয়। এতে মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম প্রবেশের সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।

গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, গরু ও ছাগলের চামড়া ২ গ্রাম/লিটার ঘনমাত্রার পার-এসিটিক এসিডে ডুবিয়ে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে চামড়ায় কোনো পঁচন বা গঠনগত ক্ষতি দেখা যায়নি।

তারা জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি খাসির চামড়া সংরক্ষণে ৩০০-৫০০ গ্রাম লবণ লাগে, যা পরবর্তীতে নদী-নালা, খাল-বিলের পানিতে মিশে জলজ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, পারএসিটিক এসিড ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ ও শ্রম দুটোই সাশ্রয় হয়। খরচ ও শ্রমিকের প্রয়োজন কম হয়। ফলে আনুষঙ্গিক ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

পরীক্ষামূলক সাফল্যের কারণে চামড়া সংরক্ষণের এই পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে যারা পরিবেশ-সচেতন এবং কম খরচে চামড়া সংরক্ষণ করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি টেকসই বিকল্প হতে পারে।

প্রধান গবেষক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য হলো— ট্যানিংয়ের আগ পর্যন্ত চামড়াটি যাতে পঁচে না যায়, সেটি নিশ্চিত করা। লবণের কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে পার-এসিটিক এসিড একটি চমৎকার সমাধান।”

তিনি বলেন, “এই পদ্ধতি যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি ব্যয়-সাশ্রয়ীও। কোরবানির পর চামড়া ছাড়ানোর ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পারএসিটিক এসিড মিশিয়ে ১ মিনিট ডুবিয়ে নিয়ে বাতাসবিরোধী (এয়ারটাইট) অবস্থায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে সহজেই ১ মাস পর্যন্ত চামড়া ভালো থাকে।”

তিনি আরো বলেন, “এই নতুন পদ্ধতিটি আরো বড় পরিসরে ব্যবহার করার জন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। কোরবানির সময় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু এলাকায় এই পদ্ধতিতে চামড়া সংরক্ষণ করলে এর উপকারিতা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। এজন্য সরকার চামড়া সংরক্ষণকারীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে এবং পার-এসিটিক এসিড সহজলভ্য করতে উদ্যোগ নিতে পারে। জেলা প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ অফিস একসঙ্গে কাজ করলে এটি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে পরিবেশের ক্ষতি কম হবে এবং খরচও বাঁচবে—যা দেশের চামড়া শিল্পের জন্য ভালো দিক হতে পারে।”

ঢাকা/মেহেদী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়