আড্ডা-আন্দোলন আর গল্পে বোনা খুবির স্মৃতিময় স্থানগুলো
মো. হাসিবুল হাসান, খুবি || রাইজিংবিডি.কম
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) শুধু একাডেমিক চর্চার স্থান নয়, বরং শিক্ষার্থীদের আবেগ, বন্ধুত্ব, মতপ্রকাশ, সাংস্কৃতিক চর্চা ও আন্দোলনের এক জীবন্ত মঞ্চ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে কিছু নির্দিষ্ট স্থান, যেখানে গড়ে ওঠে সম্পর্ক, শুরু হয় বিপ্লব, আর জন্ম নেয় নতুন গল্প।
ক্যাফেটেরিয়া, হলরোড, হাদি চত্বর, লেকপাড়, তপন দা’র দোকান- অন্যতম এই স্থানগুলো খুবির জীবনের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট।
খুবির প্রাণকেন্দ্র বলা হয় ক্যাফেটেরিয়াকে। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে ভিড় জমে শিক্ষার্থীদের। টেবিল ঘিরে চলতে থাকে বিভিন্ন আলোচনার ঝড়। সাহিত্য, ক্লাস, সংগঠন কিংবা সামাজিক ইস্যু- সবকিছুই স্থান পায় এই ছোট্ট জায়গার প্রতিটি কোণায়।
শুধু ক্লান্তি দূর করার জায়গা নয়, বরং অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ক্লাবের প্রাথমিক পরিকল্পনা, প্রজেক্ট মিটিং এবং রিহার্সেল আয়োজনও শুরু হয় এখান থেকে। চায়ের ধোঁয়া আর খাবারের গন্ধ মিলেমিশে ক্যাফেটেরিয়ায় তৈরি করে এক বৈচিত্র্যময় পরিবেশ। দিন শেষে এই জায়গাটাই হয়ে ওঠে মানসিক প্রশান্তির আশ্রয়, নতুন মুখে বন্ধুত্বের শুরু আর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের পুনরায় জোড়া লাগানোর জায়গা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম চলমান ও জীবন্ত স্থান হলো হলরোড। এটি কেবল চলাচলের পথ নয়, বরং বন্ধুত্ব, পরিচয় এবং মতবিনিময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ স্পট। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হলরোডে ভিড় জমে নানা ব্যাচের শিক্ষার্থীদের।
হলরোড যেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খোলা পাঠশালা, যেখানে জীবন শেখার পাঠ চলে নির্বিচারে। গান, কবিতা, আড্ডা, আলোচনা সবকিছুই ঘটে এই জায়গায়, যা একে করে তুলেছে ক্যাম্পাস সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে আন্তঃব্যাচ সম্পর্ক, যার ভিত্তিতে তৈরি হয় নেতৃত্ব, সহযোগিতা ও ঐক্যের বন্ধন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, মানববন্ধন বা প্রতিবাদী কর্মসূচির সূচনা হয় হাদি চত্বর থেকে। এটি একটি ঐতিহাসিক ও কৌশলগত স্থান, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বারবার উচ্চারণ করেছে তাদের অধিকারের ভাষা। ক্যাফেটেরিয়ায় হওয়া পরিকল্পনার বাস্তব রূপ নেয় এই হাদি চত্বরে দাঁড়িয়ে, যেখানে মিছিলের প্রথম স্লোগান ধ্বনিত হয়। হাদি চত্বর কেবল একখণ্ড খোলা জায়গা নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশ, সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা এবং নেতৃত্ব গঠনের শক্তির প্রতীক।
সবচেয়ে মনোরম এবং নিরিবিলি জায়গাগুলোর একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকপাড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই স্থানটিতে শিক্ষার্থীরা সময় কাটায় নির্জনে, ছবি আঁকে, গান গায়, কবিতা লেখে কিংবা নিঃশব্দে বসে থাকে। বিশেষ করে চারুকলা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি একটি উন্মুক্ত কর্মশালা যেখানে রঙ, আলো, শব্দ আর নীরবতায় মিশে যায় তাদের সৃজনশীলতার অভিব্যক্তি। শুধু শিল্পচর্চা নয়, বন্ধুত্ব গড়া, সম্পর্কের গভীরতা সৃষ্টি এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য লেকপাড় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের কাছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা আরেকটি আইকনিক স্থান হলো তপন দা’র দোকান। এটি শুধু একটি চায়ের দোকান নয়, বরং ক্যাম্পাস-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। সন্ধ্যার পর এখানে জমে ওঠে গান-বাজনা, আড্ডা আর গল্প। প্রেমের সূচনা থেকে বন্ধুত্বের টানাপোড়েন সবকিছুর সাক্ষী এই দোকান।
প্রচলিত ‘ট্রেন্ড’ অনুযায়ী, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা এখানে একা যান না। তাদের নিয়ে যান সিনিয়ররা, আর সেখান থেকেই তৈরি হয় আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায়। দোকানের মালিক তপন দা’ও শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠেছেন একান্ত আপনজন।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ডিসিপ্লিনের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুহিন রুমি বলেন, “ক্যাফেটেরিয়ার কাটানো সময়গুলি চায়ের উপরে উঠা ধোঁয়ার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকে। এছাড়া একাডেমিক কাজ যেমন- ক্লাব, প্রোজেক্টের জন্য এখানে এসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অর্ক মন্ডল বলেন, “আমরা প্রতিদিন ক্লাস শেষে এসব স্থানে জড়ো হই। কেউ গান করে, কেউ কবিতা পড়ে। আড্ডা শুধু বিনোদন নয়, অনেক সময় সামাজিক ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়।”
ঢাকা/মেহেদী