বাকৃবির উদ্ভাবিত বায়োচার কোটেড ন্যানো ইউরিয়াতে অপচয় কমবে ২৫ শতাংশ
বাকৃবি প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
দেশের কৃষিতে দীর্ঘদিনের বড় সমস্যা ইউরিয়া সারের অপচয়। মাঠে প্রয়োগ করা ইউরিয়ার বড় একটি অংশ গাছ গ্রহণ করতে না পারায় তা বাতাসে উড়ে যায়। মাটির নিচে লিচিং হয়ে পানি দূষণ ঘটায় কিংবা গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে পরিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করে। এই সঙ্কটের টেকসই সমাধানে নতুন সম্ভাবনার কথা জানালেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। তারা প্রথমবারের মতো ন্যানো বায়োচার (কার্বন) সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের দাবি করেছেন, যা ব্যবহার করলে ইউরিয়া সারের অপচয় কমপক্ষে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব হবে।
বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন গবেষক দলের প্রধান কৃষিতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) আর্থিক সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে ২০২৩ সাল থেকে। এই গবেষণায় অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সিএসও ড. শেখ মনজুরা হক, বাকৃবির মৃত্তিকা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহসিনা শারমিন হক, পিএইচডি ফেলো মো আমজাদ হোসেন এবং বুয়েটের শিক্ষার্থী মো. রোকনুজ্জামান রিপন।
অধ্যাপক ড. খায়রুল জানান, “আমরা দুইটি পদ্ধতি ব্যবহার করে ন্যানো ইউরিয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি । আমাদের তৈরিকৃত ন্যানো ইউরিয়া ২০-৫০ ন্যানো মিটারের । পাশাপাশি ন্যানো ইউরিয়াকে ন্যানো কার্বন কোটেড করা হয়েছে; যা ইউরিয়ার নাইট্রোজেন মুক্ত করার প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করেছে। ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে নাইট্রোজেন মুক্ত করা সম্ভব হবে। এতে, নাইট্রোজেনের অপচয় কম হবে এবং কৃষকেরা কম ইউরিয়া সার ব্যবহার করার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। পাশাপাশি ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে ফসল উৎপাদন বেড়ে যাবে। আমাদের মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা এখনো বাকি; তবে আশা করা যায়, আগামী বোরো মৌসুমের পরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। আমাদের লিটারেচার রিভিউ অনুসারে এই ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে ২৫ শতাংশ কম ইউরিয়া লাগবে। বায়োচার কোডের ন্যানো ইউরিয়া পরিবেশবান্ধব। এর ফলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমে যায়। আশা করি এর মাধ্যমে কৃষক এবং দেশ উপকৃত হবে। পাশাপাশি সরকার ইউরিয়া খাতে যে ভর্তুকি দেয় তার পরিমাণ কমে আসবে।”
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের বিষয়ে তিনি বলেন, “হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট- ইউরিয়া, ইউরিয়া-ন্যানো বায়োচার এবং হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট-ইউরিয়া-ন্যানো বায়োচার এই তিনটি ন্যানো হাইব্রিড ম্যাটেরিয়ালস সফলভাবে ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন সম্পন্ন হয়েছে। এফটিআইআর বিশ্লেষণে শক্তিশালী রাসায়নিক বন্ধন ও ফাংশনালাইজেশন নিশ্চিত করা হয়েছে। টিইএম বিশ্লেষণে কণার আকার ৩০-৩২ ন্যানোমিটারের মধ্যে পাওয়া গেছে; যা গাছের কোষে সহজে প্রবেশ করতে পারবে। প্রচলিত ইউরিয়া সার ব্যবহারের কার্যকারিতা মাত্র ৩০-৪০শতাংশ, যেখানে অ্যামোনিয়া গ্যাস, লিচিং, রান অফ এবং ডিনাইট্রিফিকেশন এর মাধ্যমে মোট ৫৫-১০০শতাংশ পর্যন্ত অপচয় ঘটে। এই বিশাল অপচয়ের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমনের মাধ্যমে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটে (যা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ৩০০ গুণ শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস) এবং বৈশ্বিকভাবে ২৬-৪০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এ সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে প্রায় অপচয়হীন ন্যানো সার তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যা একবার প্রয়োগের সুবিধার কারণে শ্রম খরচ কমাবে।”
ন্যানো-কার্বন ইউরিয়া সার ব্যবহারের সুবিধার বিষয়ে তিনি বলেন, “নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা ৭৫-৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে; যা গাছের চাহিদা অনুযায়ী নাইট্রোজেন রিলিজ নিশ্চিত করে এবং ন্যানো সারের ব্যবহারে আর্থিক ফলন নিশ্চিত হয়। অ্যামোনিয়া অপচয় ৮০-৯০ শতাংশ কম হয়, নাইট্রেট লিচিং ৬৫-৭৫ শতাংশ কম এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গমন ৪০-৫০ শতাংশ কম করে। যার ফলে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ধানের ফলন ১০-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে এবং প্রোটিনের উপাদান ৮-১২শতাংশ বৃদ্ধি করে ফসলের গুণগত মান উন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমবে, ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
পিএইচডি ফেলো মো. আমজাদ হোসেন বলেন, “ভারত থেকে অনেকেই তরল ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে এসে ল্যাবে দিচ্ছে। কিন্তু, আমরাই প্রথম ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে সংশ্লেষণ করেছি। মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণ সফল হলে দেশের জন্যে এটি একটি মাইলফলক হবে।”
বাকৃবির মৃত্তিকা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহসিনা শারমিন হক বলেন, “নাইট্রোজেন ম্যাক্রো পুষ্টি উপাদান হওয়ায় এটি মাইক্রো পুষ্টি উপাদানের মত করে প্রয়োগ করলে তা অনেক ক্ষেত্রে ফসলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে; বিশেষত মাটির উর্বরতায়। পাতায় প্রয়োগের ফলে ব্যবহারের কার্যকরী ক্ষমতা কমে গিয়েছে। তাই আমরা আশা করছি ন্যানো ইউরিয়া মাটি এবং ফসলের গোড়ায় ব্যবহারে সাফল্য পাবো । এর মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। সামনে আরো মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা নাইট্রোজেন মুক্ত হওয়ার ধরন এবং এটি প্রয়োগ করার ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবো।”
কেজিএফের নির্বাহী পরিচালক নাথু রাম সরকার গবেষণাটির বিষয়ে বলেন, “খামারীদের সরাসরি উপকার করবে এমন একটি প্রযুক্তি এটি। আমাদের গবেষকরা বলেছেন যে আমরা সাধারণত ৪০ শতাংশ সার কাজে লাগাতে পারি। বিশেষ করে ইউরিয়া যেটা মাঠ পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু, যখন আমরা ন্যানো আকারে দিব তখন এটার ব্যবহার দক্ষতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে, ফসলের উৎপাদন বাড়বে, পরিবেশ দূষণ কমবে এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষিত হবে। এই প্রযুক্তিগুলোই দেশের উদ্ভাবনের জন্য আমরা বিজ্ঞানীদের অর্থায়ন করে থাকি এবং তার একটি কাজ হলো ন্যানো বায়োচার কোডেট ন্যানো ইউরিয়া। শস্য উৎপাদনের সাথে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উন্নয়নের জন্য ন্যানো টেকনোলজি এখন উন্নয়ন বিশ্বে ব্যবহার হচ্ছে।”
কেজিএফের ক্লাইমেট এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্সের সিনিয়র স্পেশালিস্ট ড. মো. মনোয়ার করিম খান বলেন, “আমরা যে ইউরিয়াটি বর্তমানে উন্নত করছি, সেটি ব্যবহার করলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ইউরিয়া কম প্রয়োগ করেও ফলন কমবে না। এর ফলে শুধু উৎপাদন খরচ কমবে না বরং জমির স্বাস্থ্য উন্নত হবে এবং পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষক ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় করবে। এই উদ্ভাবিত সারটি সাধারণ ন্যানো ইউরিয়া নয় বরং এটি বায়োচার কোটেড বা কার্বন কোটেড ন্যানো ইউরিয়া। এর বিশেষত্ব হলো বায়োচার কোটিংয়ের কারণে ইউরিয়া ধীরে ধীরে মুক্ত হয়। ফলে গাছ প্রয়োজন অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরে নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে।”
বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়ার প্রধানত দুটি বড় সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, ইউরিয়ার ব্যবহার ও খরচ সাশ্রয়। প্রচলিত ইউরিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে গাছ সর্বোচ্চ মাত্র ৪০ শতাংশ নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে। বাকি প্রায় ৬০ শতাংশ নাইট্রোজেন নষ্ট হয়ে যায়। যা ভোলাটিলাইজেশন প্রক্রিয়ায় বায়ুতে উড়ে যায় অথবা লিচিংয়ের মাধ্যমে মাটি ও পানিতে প্রবেশ করে খাল-বিল, নদী ও নর্দমায় পৌঁছে যায়। বায়োচার কোটিং থাকার কারণে এই অপচয় অনেকাংশে কমে আসে।”
দ্বিতীয়ত, পরিবেশ সুরক্ষা ও জমির স্বাস্থ্য উন্নয়ন। অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারে মাটির জৈবগুণ নষ্ট হয় এবং পানি ও বায়ু দূষণ বাড়ে। কিন্তু কোটেড ন্যানো ইউরিয়ায় নাইট্রোজেন ক্ষয় কম হওয়ায় মাটিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে না। ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের ঝুঁকি কমে এবং পরিবেশের ওপর চাপ হ্রাস পায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুস ছালাম এ বিষয়ে বলেন, “আমাদের লক্ষ্য টেকসই, নিরাপদ ও লাভজনক কৃষি ব্যবস্থা। এখন কৃষিকে লাভজনক করতে হলে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ২.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হয়। এদিকে বেশি পরিমাণ সার ব্যবহার করার ফলে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি ইউরিয়া সারের পরিবর্তে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করতে পারি তাহলে একদিকে ইউরিয়ার পরিমাণ কম লাগবে। অন্যদিকে কম ইউরিয়া ব্যবহার করায় পরিবেশ সুরক্ষিত হবে এবং উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। আমাদের দেশের কৃষির ৩০ টি বিশেষ অঞ্চলে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যানো ইউরিয়া কতটুকু মাত্রায় প্রয়োগ করা দরকার তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কোন অঞ্চলে এবং কোন ফসলের জন্য কি পরিমাণ ন্যানো ইউরিয়া প্রয়োজন তা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে সুনির্দিষ্ট ভাবে কৃষকদের জানানো প্রয়োজন। এভাবে কৃষকদের নির্দেশনা প্রদান করতে পারলে কৃষকরা উপকৃত হবেন বলে আশাবাদী।”
ঢাকা/লিখন/জান্নাত