ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘নারী উদ্যোক্তা নগরী’ কেন প্রয়োজন

আতিকুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৭, ২৬ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:২৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২১
‘নারী উদ্যোক্তা নগরী’ কেন প্রয়োজন

নারীর জন্য আলাদা আইন বা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা নয়। কেননা নর-নারী মিলেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ। একজন ছাড়া অপরজন অপূর্ণাঙ্গ। উভয়ই মানুষ, যদিও আকৃতি প্রকৃতিতে ভিন্নতা আছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে উভয়ের সমঅবস্থা, সমমর্যাদা থাকা উচিত। যে কারণে রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবে অভিন্ন আইন ও নীতিতে উভয়ের চলার কথা ছিল। 

তারপরও নারী অধিকার রক্ষা আইন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন কেন? আবার মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা অধিদপ্তরই বা কেন? নিয়ম অনুযায়ী থাকার কথা নয়। তারপরও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণেই এর উদ্ভব এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সামাজিক রীতিনীতি, কুসংস্কার, সামাজিক ক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে নারীর  পশ্চাৎপদতার কারণেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পৃথক মহিলা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিশেষ প্রকল্প নারীর অধিকার সুরক্ষায় বিশেষ আইন প্রণীত হচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও নারীর পশ্চাৎপদতা হ্রাসে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। 

এবার আলোচনা করি কেন ‘নারী উদ্যোক্তা নগরী’ গড়ার ধারণা প্রস্তাব করছি। স্বাধীনতা, মুক্তি, অধিকার আর মর্যাদা যাই বলুন না কেন মানুষের অর্থ নৈতিক মুক্তি সবার আগে, নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতাও সর্বাগ্রে নির্ভর করছে তার অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, যৌতুক প্রথা প্রতিরোধ, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা কেবল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে হবে না, যদি না নারী স্বাবলম্বী হয়। কোনো নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, তখন পরিবার বা সমাজে সে আর অবহেলিত হবে না। বিশ্বেও জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। তেমনি বাংলাদেশেরও মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। তাই দেশের যথাযথ উন্নয়নে নারীর মেধা ও শ্রমশক্তির প্রয়োগ আবশ্যক। 

দেশের অর্ধেক মানুষের মেধা ও শ্রম অলস পড়ে থাকলে বা অব্যবহৃত থাকলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই বিবিধ কারণে অর্থাৎ নারীর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তা নগরী প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এজন্য পৃথক নারী উদ্যোক্তা নগরী প্রযোজন কেন? নারীরা তো উদ্যোক্তা হচ্ছে, নারীরা তো চাকরিও করছে। করছে বটে। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। বাংলাদেশের মোট নারী জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ কর্ম প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত। নারী জনসংখ্যার বৃহদাংশ এখনো ঘর সংসার নিয়েই আছেন। তাদের মেধা ও শ্রম অব্যবহৃত আছে। তাদের মেধা ও শ্রম অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া, নারীর কর্মপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা আছে। 

প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ, কুসংস্কার, ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাসহ নানা কারণে নারীরা লেখাপড়া বা কাজকর্ম করতে পারছেন না। আমাদের সমাজে যে রক্ষণশীলতা বিরাজ করছে, তা রাতারাতি পরিবর্তনও করা যাবে না। আবার কর্মপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত নারীদের অনেকে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন প্রকার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যে কারণে নারীরা কর্মপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে ভয় পান। তাই একটি পৃথক নারী উদ্যোক্তা নগরী হলে সেখানে সর্বস্তরের নারীরা সম্পৃক্ত হতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন। 

এখন প্রশ্নটা হচ্ছে নারী উদ্যোক্তা নগরী কেমন হবে। কেবল নারীর জন্য নারীদের দিয়ে পরিচালিত হবে নারী উদ্যোক্তা নগরী। এখানে নারী উদ্যোক্তা, নারীই শ্রমিক, নারীই পরিচালক। নারী উদ্যোক্তা নগরী অনেকটা বিসিক শিল্প নগরীর আদলে হতে পারে। তবে নারী উদ্যোক্তা নগরী হবে বহুমুখী। এই নগরীতে নারীদের উদ্যোগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপিত হবে। এই শিল্পের ব্যবস্থাপক, শ্রমিক সবাই হবে নারী। শিল্প কারখানা ছাড়াও এখানে নারীদের পরিচালনায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও থাকবে। যেমন ছোট, বড় শপিংমল, বিউটি পার্লার, হাসপাতাল, জিমনেসিয়ামসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সেবা প্রতিষ্ঠান থাকবে। 

এই নগরীতে নারীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও থাকবে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ পেশাগত দক্ষতা অর্জনে বিভিন্ন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থাকবে। যেখানে নারীরাই শিক্ষক আবার নারীরাই শিক্ষার্থী। প্রয়োজনে এখানে নারীদের জন্য আবাসিক হলের ব্যবস্থা থাকবে। নগরীতে আসা যাওয়ার জন্য বাস-ট্রাকসহ যে পরিবহন ব্যবহৃত হবে, তাও নারীরা পরিচালনা করবে। এক কথায় নারীর জন্য একটি আলাদা জগত। যেখানে নারীরা স্বাচ্ছন্দে কাজ করবে। তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। নারী হবে উদ্যোক্তা। অলস মেধা-শ্রম আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রয়োগ করে দেশ গঠনের গর্বিত অংশিদার হবে নারী। 

নিঃসন্দেহে নারী উদ্যোক্তা নগরী অনেক বড় প্রকল্প, এটা অনেক ব্যয়বহুল বিধায় ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্য নিতে পারে। আবার সরকারি বেসরকারি পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় হতে পারে। এক্ষেত্রে সমবায় পদ্ধতিও প্রয়োগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুসারে প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী উদ্যোক্তা নগরী স্থাপিত হতে পারে। প্রথমে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বাংলাদেশের অনুন্নত একটি জেলায় নারী উদ্যোক্তা নগরী প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। 

পর্যায়ক্রমে সব জেলায় এই নারী উদ্যোক্তা নগরী স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে সরকারকে সুবিধাজনক স্থানে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কেবল নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে প্লট বরাদ্দ করলেই হবে না। পাশাপাশি টেকনিক্যাল ও আর্থিক সাহায্য করতে হবে। সরকারিভাবে নারী উদ্যোক্তাদের শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা স্থাপনের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী উদ্যোক্তা নগরী মহিলা অধিদপ্তরের অধীনে হতে পারে, আবার নারী উদ্যোক্তা নগরী  কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। এই কর্তৃপক্ষ নগরী স্থাপন, পরিচালন ও নজরদারী করবে। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংককেও ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করতে হবে। কোনো কিছুই অসাধ্য নয়, সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে খুব সহসাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নারী উদ্যোক্তা নগরী। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়