হারিয়ে যাচ্ছে ঘুঘুর ডাক!
|| রাইজিংবিডি.কম
বিরল প্রজাতির সবুজ ঘুঘু
আবদুল মান্নান পলাশ
চাটমোহর, ৫ জুলাই : এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে/এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে/জামের আড়ালে সেই বউ কথা কওটিরে যদি/ফেলো দেখে/একবার,-একবার দু’-প্রহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে/ধরা দাও,- তা হ’লে অনন্তকাল থাকিতে যে, হ’বে এই বনে।
জীবনানন্দের ‘এখানে ঘুঘুর ডাকে’ নামের কবিতার সেই ঘুঘু আর নেই বনে। শুনা যায় না তার মিষ্টি ডাক। কোথায় গেলো ঘুঘু পাখিটি। গ্রাম বাংলার মিষ্টি পাখি ঘুঘুর বংশে ঘুঘু চরার দশা এখন।
ঘুঘুদের বসবাসের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। যত্রতত্র ইটভাটায় গিলে খেয়েছে বড়বড় গাছ। আর পাখি শিকারিদেও শ্যেন দৃষ্টি থেকে সত্যি সত্যি রক্ষা করা যায়নি পাখিদের।
ঘুঘু এখন দেশে এক বিপন্ন পাখি। মাংস স্বাদু, সেটাই হয়েছে ঘুঘুর মহাশত্রু। বাগানে বা ঝোপ-জঙ্গলে এই পাখিটি শিকারিদের বন্দুক ও তীরের লক্ষবস্তুু হয়েছিলো। আর পোষা ঘুঘু দিয়ে ফাঁদ পেতে ঘুঘু ধরার কৌশলটি তো অতি পুরনো। ঘুঘু নিয়ে আমাদের গ্রাম বাংলায় রয়েছে অনেক ছেলে ভুলানো প্রবচনমালা।
কাউকে নির্বংশ করা বোঝাতে বলা হয়- ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে দেওয়া হবে। বলা হয়-বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান/এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ/ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখোনি ইত্যাদি। আবার গ্রামে শিশুদের ভোলাতে পায়ের উপর রেখে দুলুনি দিয়ে বলা হয়- ঘুঘু সই/ফুফু কই এর মতো ছড়া।
ঘুঘুর এক নাম বনকপোত। পায়রা, ঘুঘু, হরিয়াল সব একজাতের পাখি। বিশ্বে কলম্বিডি নামের এই পাখি আছে ৩১০ প্রজাতির। আমাদের দেশে আছে ১৬ প্রজাতির। তারমধ্যে ঘুঘুই আছে অনন্ত ৭ প্রজাতির।
সচরাচার সারাদেশে যে সব ঘুঘু দেখা যায়, সে গুলো হলো- তিলে ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু আর ঝেযে ঘুঘু। বুকের নীচে ধুসর রং। পিঠ বাদামি। গলায় কালোর মধ্যে সাদা ফোঁটা।
আকার ২৮/৩০ সেন্টিমিটার। অপেক্ষাকৃত নীচু ঝোপঝাড়ে ঘুঘু বাসা বাঁধে। প্রতিবার একজোড়া করে বছরে ৩ বার ডিম দেয়। বাচ্চা ফুটলে প্রথম ২/৩ দিন মা ঘুঘুর মুখ দিয়ে এক ধরনের লালার নিঃসরণ হয়। এটাই ছানার খাদ্য।
দেশে সবচেয়ে ঘুঘুর সংখা কমেছে উত্তরাঞ্চলে। ঘুঘু সবচেয়ে বেশী শিকার করা হয় এয়ারগানে। অথচ দেশে পাখি শিকার আইনতঃ নিষিদ্ধ। কিন্তু পাখি শিকারের জন্য এখনো এই এয়ারগান বিক্রি হয়ে থাকে। এটা আইনের একেবারেই বিপরীত।
পাখি বিশারদরা বলেছেন, গত ৩০ বছরে ঘুঘুর সংখ্যা কমেছে ব্যাপকভাবে। কোন কোন এলাকায় কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। তিলে, ঝেযে ও সবুজ ঘুঘু ছাড়াও আমাদের দেশের অন্য ঘুঘুর মধ্যে আছে বাজ ঘুঘু, মটর ঘুঘু, ছোট ঘুঘু, লাইছে ঘুঘু, বাঁশ ঘুঘু ও ধূমকল ঘুঘু। আকারে ধূমকলঘুঘুই সবচেয়ে বড়।
নিরীহ এই পাখিটি মানুষের লোভের শিকার হয়ে হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে দেশ থেকে। তখন শুধু জীবনান্দের কবিতার পঙতিতে থাকবে তার কথা-‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;/পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে।
বাস্তবে ঘুঘু ডাকা দুপুরগুলো আসবে না ফিরে আর।
রাইজিংবিডি/শাহ মতিন টিপু/এলএ
রাইজিংবিডি.কম