রেনেসাঁর কবি
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
কবি ফররুখ আহমদ
শাহ মতিন টিপু : ফররুখ আহমদকে বলা হয় রেনেসাঁর কবি। সাহিত্যের নানা শাখায়ই বিচরণ ছিল এই কবির। তার রচিত অনেক কবিতা এখনো জনপ্রিয়। ‘পাঞ্জেরি’ তেমনই একটি কবিতা। যার আবৃত্তিও অনেক শ্রুতিমধুর-
‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?’
এমন আরো অনেক জনপ্রিয় কবিতা আছে ফররুখের। তার ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতাটির কয়েকটি চরণ এ রকম-
‘কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না ? তবু, তুমি জাগলে না ?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকো জাহাজ,
অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।’
আবার সিন্দাবাদ কবিতায়-
‘ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ।’
ফররুখ আহমদের ৪২ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর কবি তার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। কবির শেষজীবন কেটেছে খুবই অর্থকষ্টে। ওই সময়ে দৈনিক গণকন্ঠে কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা লেখেন- ’খবর পেয়েছি বিনা চিকিৎসায় কবি ফররুখ আহমদের মেয়ে মারা গেছে। এই প্রতিভাধর কবি যার দানে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে- পয়সার অভাবে তার মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারেননি, ওষুধ কিনতে পারেননি। কবি এখন বেকার। তার মৃত মেয়ের জামাই, যিনি এখন কবির সঙ্গে থাকছেন বলে খবর পেয়েছি তারও চাকুরি নেই। মেয়ে তো মারাই গেছে। যারা বেঁচে আছেন, কি অভাবে, কোন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন, সে খবর আমরা কেউ রাখিনি।’
ফররুখ আহমদের জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার।
তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ-এর দশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। তার নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ 'উপহার' নামে একটি কবিতা লেখেন যা 'সওগাত' পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তারা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান (আহমদ আখতার), সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কোলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক 'মোহাম্মদী'-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘সিরাজাম মুনীরা’, ‘নৌফেল ও হাতেম’, ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘ধোলাই কাব্য’, ‘হাতেম তায়ী’, ‘নতুন লেখা’, ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’, ‘সিন্দাবাদ’, ‘দিলরুবা’ ইত্যাদি।
তিনি ছড়া তৈরিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ছোটদের জন্য মজার মজার ছড়া লিখেছেন তিনি। যেমন-
‘বিষটি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাস বনে
বকের সারি কোথারে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।
নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকলো দূরে দেয়া যে,
কোন্ সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে!’
‘ঝুমকো জবা’ শিরোনামের ছড়াটি এ রকম-
‘ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠল ফুটে বনের ফুল।
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।
সেই দুলুনির তালে তালে,
মন উড়ে যায় ডালে ডালে।’
এভাবে অপূর্ব ছন্দের সম্মোহনী উপহার দিয়েছেন ছড়ায় ছড়ায়। আবার-
‘ডালে ডালে পাখির বাসা
মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা
সাত সাগরে নদীর বাসা
কুলুকুলু নদীর ভাষা।
হাজার সুরের হাজার ভাষায়
এ দুনিয়া ঘেরা
আর মাতৃভাষা বাংলা আমার
সকল ভাষার সেরা।'
ফররুখ রেনেসাঁর কবি হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি ছিলেন মানবতার কবি, ফুল-পাখিদের কবি, ছোট-বড় সবার কবি। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন অনেক মজার মজার ছড়া কবিতা, গান, গল্প ও নাটক-নাটিকা। ‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’, ‘ছড়ার আসর’, ‘নয়া জামাত’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘কাফেলা’, ‘আলোকলতা’, ‘খুশীর ছড়া’, ‘ছড়াছবির দেশে’, ‘পাখির ছড়া’, ‘রঙমশাল’ ইত্যাদি তার লেখা উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ।
সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় ছিল 'কবি'। ফররুখ আহমদ কিছু সনেট রচনারও করেছেন তার রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এক অমূল্য সম্পদ। ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটিকে বাংলার অনেক কবি সাহিত্যিক ‘মহাকাব্য ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবি এখানে পৌরাণিক উপমার আশ্রয় না নিলেও মুসলিম ঐতিহ্যের উপমা সম্ভার ভাষা ও ছন্দের মনোহারিত্বে বর্ণনা করেছেন। এ কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
কবি সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৬/ টিপু/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম