ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

লালসালু’র স্রষ্টা

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ১৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লালসালু’র স্রষ্টা

বিদেশিনী স্ত্রীর সঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

রুহুল আমিন : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ  আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাশিল্পী। কল্লোল যুগের ধারাবাহিকতায় তার আবির্ভাব। তবে তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতায় পরিশ্রুত নতুন সাহিত্য বলয়ের সৃষ্টি করেন। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উত্তরসূরি এই কথাসাহিত্যিক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করলেও বিষয়, কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গীতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামের ষোলশহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, মা নাসিম আরা খাতুনও উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবারের মেয়ে ।ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গেও ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক মধুর ছিল ।

পারিবারিক পরিমণ্ডলের সাংস্কৃতিক প্রতিবেশ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনন ও রুচিতে প্রভাব ফেলেছিল। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ওয়ালীউল্লাহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অংশ দেখার সুযোগ লাভ করেন। ওয়ালীউল্লাহর শিক্ষাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন।

ছাত্রজীবনে তিনি একাধিক মাসিকপত্রে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে জড়িত থাকার সূত্রে কর্মজীবনের বড় একটা সময় তিনি বিদেশে কাটান। ১৯৫৫ সালে তিনি ফরাসি আন মারী-র সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

ছাত্র অবস্থাতেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় চাকরি নেন। এ বছর তার বাবাও মারা যান। তার তিনমাস আগে মার্চ মাসে তার প্রথম গ্রন্থ নয়নচারা গল্পগ্রন্থ বের হয়। নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন ১৯৪১-৪২ সাল নাগাদ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরই তিনি দ্য স্টেটসম্যান এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা চলে আসেন এবং সেপ্টেম্বরে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদকের চাকরি নেন। কাজের ভার কম ছিলো, লালসালু উপন্যাস লেখায় হাত দেন । পরের বছরই এ উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে কমরেড পাবলিসার্স। ঢাকা থেকেই বের হল।

১৯৪৮ সালে করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হয়ে ঢাকা ছাড়েন । সেখান থেকে ১৯৫১ সালে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে তৃতীয় সেক্রেটারির পদমর্যাদায় বদলি হন।১৯৫২ সালের শেষের দিকে একই পদে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বদলি হন।১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে এলেন তথ্য অফিসার হিসেবে ঢাকাস্থ আঞ্চলিক তথ্য-অফিসে। ১৯৫৫ সালে পুনরায় বদলি করাচির তথ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালকের পদাভিষিক্ত হয়ে। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে দেড় বছর পর পদটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে জাকার্তার পাকিস্তানি দূতাবাসে দ্বিতীয় সেক্রেটারির পদমর্যাদায় রয়ে গেলেন ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর অবধি। এরপর ক্রমান্বয়ে করাচি-লন্ডন-বন-এ বিভিন্ন পদে ও বিভিন্ন মেয়াদে কর্মরত ছিলেন।

১৯৬১ সালের এপ্রিলে ফার্স্ট সেক্রেটারির পদমর্যাদায় যোগ দিলেন পারীর দূতাবাসে। একনাগাড়ে ছ'বছর ছিলেন তিনি এ শহরে। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিলো লালসালুর ফরাসি অনুবাদ লারব্র্ সা রাসিন (L'arbre sans racines, অর্থাৎ শিকড়হীন গাছ)। দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে চুক্তিভিত্তিক প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট পদে যোগ দেন ইউনেস্কোতে। ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট চাকরিস্থল ছিলো প্যারিস শহরেই ইউনেস্কো সদরদপ্তরে। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইউনেস্কোতে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। অবসরগ্রহণের নিয়ম হিসেবে পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদে বদলি করে কিন্তু তিনি প্যারিসেই থেকে গিয়েছিলেন।

তার স্ত্রী ফরাসিনী। নাম আন্-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবো। তাদের আলাপ হয়েছিলো সিডনিতে। ওয়ালীউল্লাহ যেমন পাকিস্তানি দূতাবাসে, আন্-মারি তেমনি ছিলেন ফরাসি দূতাবাসে। দেড়-দু বছরের সখ্য ও ঘনিষ্টতা রূপান্তরিত হয় পরিণয় বন্ধনে। ওয়ালীউল্লাহ তখন করাচিতে। সেখানেই ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। ধর্মান্তরিত বিদেশিনির নাম হয় আজিজা মোসাম্মত নাসরিন। তাদের দু সন্তান। প্রথমে কন্যা সিমিন ওয়ালীউল্লাহ, তার পরে পুত্র ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রাজনীতিসম্পৃক্ত মানুষ ছিলেন না, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন  বেকার। তা সত্ত্বেও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করেছেন, সঙ্গতিতে যতোটুকু কুলোয় তদানুযায়ী টাকা পাঠিয়েছেন কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। তার সন্তানদের ধারণা, তাদের বাবার অকাল মৃত্যুর একটি কারণ দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও হতাশা। তিনি যে স্বাধীন মাতৃভূমি দেখে যেতে পারেননি সে বেদনা তার ঘনিষ্ঠ মহলের সকলেই বোধ করেছেন। তার ছাত্রজীবনের বন্ধু পরবর্তীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর সাত মাস পরে তার স্ত্রীকে এক আধা সরকারি সান্তনা বার্তা পাঠিয়েছেন। তাতে লেখা ছিল,“আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মি. ওয়ালীউল্লাহর মাপের প্রতিভার সেবা গ্রহণ থেকে এক মুক্ত বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো; আমাকে এটুকু বলার সুযোগ দিন যে আপনার ব্যক্তিগত ক্ষতি বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতি।’

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র গ্রন্থতালিকায় রয়েছে উপন্যাস : লালসালু , চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো।
ছোটগল্প : নয়নচারা, জাহাজী, পরাজয়, মৃত্যু-যাত্রা, খুনী, রক্ত, খণ্ড চাঁদের বক্রতায়, সেই পৃথিবী।
অন্যান্য গল্প : দুই তীর, একটি তুলসী গাছের আত্মকাহিনী, পাগড়ী, কেরায়া, নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা, গ্রীষ্মের ছুটি, মালেকা, স্তন, মতিন উদ্দিনের প্রেম।

অগ্রন্থিত গল্পাবলির মধ্যে রয়েছে : সীমাহীন এক নিমেষে, চিরন্তন পৃথিবী, চৈত্র দিনের এক দ্বিপ্রহরে, ঝড়ো সন্ধ্যা, প্রাস্থনিক, পথ বেঁধে দিল, মানুষ, অনুবৃত্তি, সাত বোন পারুল, সাত বোন পারুল (দ্বিতীয় দফা), ছায়া, দ্বীপ, প্রবল হাওয়া ও ঝাউগাছ, হোমেরা, স্থাবর, স্বপ্ন নেবে এসেছিল ও আর তারা, সবুজ মাঠ, স্বগত, মানসিকতা, কালচার, সূর্যালোক, মাঝি, অবসর কাব্য, নকল, রক্ত ও আকাশ, মৃত্যু, স্বপ্নের অধ্যায়, সতীন, বংশের জের, নানির বাড়ির কেল্লা, না কান্দে বাবু।
নাটক:বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ, সুড়ঙ্গ, উজানে মৃত্যু।

পুরস্কার : একুশে পদক (মরণোত্তর), আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, পি.ই.এন পুরস্কার ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০০১ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার।

অকালে চলে যান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে তার মৃত্যু হয়। গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে তিনি মারা যান। পারীর উপকণ্ঠে তারা একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, সেখানেই ঘটনাটি ঘটে এবং পারীতেই তিনি সমাহিত হন ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়