নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে দেশের প্রতিনিধিত্বকারী রাফসানের গল্প
আহসান রনি || রাইজিংবিডি.কম
রাফসান সাবাব
আহসান রনি : দিনটি ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর। তরুণ রাফসান সাবাব বসে আছেন নরওয়ের রাজধানী অসলোর গ্র্যান্ড সিটি হল-এ। হাতের কার্ডটার দিকে আবারো তাকিয়ে দেখলেন নিজের পুরো নাম লেখা আর পাশে স্বর্ণালী রঙের একটা সিল, ‘নোবেল পিস প্রাইজ ২০১৬’। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ভাবতে অবাক লাগছিল, একটু পর সত্যিই তার চোখের সামনে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন কলম্বিয়ান প্রেসিডেন্ট হুয়ান মানুএল সান্তস। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে একজন হিসেবে বসে আছেন রাফসান সাবাব! কয়েক মাস আগেও যে আয়োজনটিকে পৃথিবীর সেরা আয়োজন মনে করে টিভিতে দেখতেন বা পত্রিকায় এই আয়োজনের খবর পড়তেন, সেই আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হতে পারা সত্যিই স্বপ্নের বাস্তবে রূপ নেওয়া। তবে এই দারুণ স্বপ্নটি সফল হবার পেছনের গল্পটি এতটা সহজ ছিল না।
তখন রাফসান ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়েন। পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজগুলোতে তেমন ভালো ছিলেন না। একদিন বাবামায়ের মধ্যে হতাশাজনক কথোপকথন শুনে ফেললেন। তাঁরা বলছিলেন, ‘ছেলেটা কোনো কিছুতেই তেমন কিছু করতে পারল না, পড়াশোনায়ও মোটামুটি’। শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট রাফসান তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন ভালো কিছু করার। কিছুদিন পর মায়ের কাছে থেকে শিখেই একুশে ফেব্রুয়ারির একটা ‘আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’য় প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করেন তিনি। এবং প্রথমবারেই বাজিমাত। প্রথম পুরস্কার পান রাফসান। বাসায় আসার পর মা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! তাঁর সেই খুশি হবার ঘটনাটি এখন মনে আছে রাফসানের। এই ঘটনাটার পর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু না কিছু একটা করার দিকে ঝোঁক কাজ করত সবসময়।
কিছুদিন পর সবকিছু চিন্তাভাবনা করে বাবা-মা ক্যাডেট কলেজে পাঠিয়ে দিলেন রাফসানকে। ক্লাস সেভেনে বাবা-মাকে ছাড়া একা ভিন্ন একটি জায়গায় থাকতে যাওয়া সহজ ছিল না। প্রথম দুইমাস খুব কান্নাকাটি করতেন রাফসান। তারপর ভাবলেন মন খারাপ না করে বরং কিছু না কিছু করে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। শুরু করলেন খেলাধুলা, স্টেজ কম্পিটিশন আর পড়াশোনা। দেখতে দেখতে দ্বাদশ শ্রেণীতে এসে পুরো কলেজের নেতৃত্বের দায়ভার দেয়া হল তার কাঁধে, ‘কলেজ প্রিফেক্ট’ হিসেবে সর্বোচ্চ মানের মর্যাদা পাবার মাধ্যমে। দায়িত্ববোধ আর নেতৃত্বের মতো ব্যাপারগুলো ওখান থেকেই হাতেকলমে শেখা।
কলেজ পাশ করে ভার্সিটিতে পড়ার সময় আসলো। অনেক চিন্তাভাবনা করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-তে ভর্তি হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, পড়াশোনা ছাড়াও ভিন্নধর্মী কিছু করার ভালো একটা সময় পাওয়া যাবে এই চার বছরে।
প্রথম বছর থেকেই বিভিন্ন বিজনেস কম্পিটিশন আর আইডিয়া নিয়ে কিছু কাজ শিখতে শুরু করলেন রাফসান। টেন মিনিট স্কুলের আয়মান সাদিক তখন আইবিএ-তেই শেষ বর্ষের ছাত্র। টেন মিনিট স্কুলের একদম শুরু দিককার সময়। শেখার ইচ্ছা থেকেই যোগ দিলেন টেন মিনিট স্কুলের টিমে। এত কাছ থেকে একটি প্ল্যাটফর্মকে এত বড় অবস্থানে চলে যাওয়া দেখতে পারা এবং তার একটা অংশ হতে পারা অনেক দারুণ একটি বিষয় ছিল।
নতুন কিছু করার চেষ্টা থেমে থাকেনি। ডানে বামে অনেক কিছু নিয়ে চেষ্টা করতে করতে তিন ব্যাচমেট মুন হামান্না, অনিন্দ্য এবং জয় এর সঙ্গে একটা সোশ্যাল এন্ট্রাপ্রেনার কম্পিটিশন-এ অংশগ্রহণ করলেন। হাল্ট প্রাইজ ২০১৬-তে অংশ নিয়েছিলেন চাকরিদাতা নামের একটি প্ল্যাটফর্ম আইডিয়া নিয়ে। চাকরি ঢাকা এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে দক্ষ কিন্তু বেকার কর্মজীবীদের তথ্য একটি ওয়েবসাইট কিংবা কলসেন্টার-এর মাধ্যমে পেয়ে যাবে এমপ্লয়াররা। এই আইডিয়াটাই রাফসানের দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। বিশ্বের আরো সব দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য যাওয়ার কথা ছিল চীনের সাংহাই শহরে। কিন্তু প্রত্যাশিত আর্থিক সহযোগিতা না পাবার ফলে আর সামনে এগোনো হয়নি। রাফসানে জানালেন, ওই সময়টাতেই তিনি দুটো শপথ নিয়ে ফেললেন, আইডিয়া সফল হোক আর না হোক, চেষ্টা করবেনই। আর এমন কিছু কাজ করতে হবে যাতে বিমানের টিকেট অর্জন করতে পারেন।
খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, ঠিক দু’মাস পরেই সুইজারল্যান্ডের টিকেট পেয়ে গেলেন গ্লোবাল চেঞ্জমেকার-এর পক্ষ থেকে। উদ্দেশ্য? পুরো বিশ্ব থেকে বাছাই করা ৬০ জনের সঙ্গে এক সপ্তাহ সময় নিয়ে নতুন কিছু শেখা, নতুন ভাবে নিজেকে জানা। গত তিন বছরে ইউরোপ ও এশিয়ার ১৬টি দেশ ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে রাফসানের। এবং দারুণ বিষয় হল- কোনোবারই কিন্তু বিমানের টিকেট কিনতে হয়নি, কাজের মাধ্যমেই অর্জন করে নিয়েছেন প্রতিবার।
প্রতিবছর গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণদের মধ্য থেকে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করা তরুণদের নিয়ে দারুণ একটি আয়োজন করে। নাম টেলিনর ইয়ুথ ফোরাম। এই আয়োজনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় এবং তাদের আইডিয়া তুলে ধরেন। আইডিয়া ও প্রেজেন্টেশনের ভিত্তিতে সেরা দুইজন পান নোবেল পিস প্রাইজ আয়োজনে অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ। ২০১৬ সালে এই আয়োজনে অংশ নিয়ে সেরা হন রাফসান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল দলে খেলা বা বিভিন্ন বিজনেস কম্পিটিশনের মঞ্চে প্রেজেন্টার হিসেবে বা সারা বিশ্বে পরিচিত রোবট ‘সোফিয়া’র ইন্টারভিউ নেওয়া- রাফসান প্রতিনিয়ত নতুন ভাবে আবিষ্কার করছেন নিজেকে।
ক্লাসে ভালো না করতে পারা বা সবকিছুতে অদক্ষ সেই রাফসান নিজের চেষ্টায় বর্তমানে বিশ্বের দরবারে নানাভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। নিজে এটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন? উত্তরে রাফসান জানালেন, ‘নিজের গল্পটার দিকে তাকিয়ে নিজেই মাঝে মাঝে ভাবি, খুব সহজ ছিলনা এই পথটা পাড়ি দেয়া। তবে কিছু মানুষের ভালোবাসা আর বিশ্বাস সবসময়ই সঙ্গে পেয়েছি আর তাদের সমর্থনেই পাড়ি দিতে চাই আরো অনেকটা পথ। নিজের গল্পটা নিজের হাতে গড়তে গেলে কিছু কঠিন সময় আসবেই। তবে মন থেকে কোনো কিছু চাইলে ও পারবো বলে বিশ্বাস করে নিলে কোনো কিছুই আর কষ্টের থাকে না। ওখান থেকেই শুরু দারুণ কোনো কিছুর।’
দারুণ কিছু করতে চেষ্টা করা রাফসান সাবাবের গল্পটা শুরু হয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারার আনন্দ নিয়ে। আবার একদিন রাফসান ফিরে যেতে চান, তবে সেবার যেতে চান পুরস্কারটা নিতে।
বি: দ্র: ২০১৮ সালের টেলিনর ইয়ুথ ফোরামের আয়োজনের জন্য অ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ করা হচ্ছে। আপনিও পেতে পারেন নোবেল পিচ প্রাইজ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ। লিংকে গিয়ে নিজের আইডিয়া জমা দেওয়া যাবে। সেরা আইডিয়াগুলো থেকে কয়েকধাপ বাছাই শেষে সেরা ৭টি আইডিয়া নিয়ে আয়োজিত হবে ফাইনাল। এখান থেকে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সেরা দুইজন তরুণ নোবেল পিস প্রাইজ অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করবেন বাংলাদেশের।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ মে ২০১৮/ফিরোজ
রাইজিংবিডি.কম