ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

সেকালে বাঙালি মুসলমানের হজ পালন

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ১০ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেকালে বাঙালি মুসলমানের হজ পালন

জাহিদ সাদেক: ‘দে দে পাল তুলে দে, মাঝি হেলা করিস না/ ছেড়ে দে নৌকা, আমি যাবো মদিনা’ গানটি অনেকেই শুনেছেন। শুনে অনেকে হয়তো ভেবেছেন- নৌকায় কি মদিনায় যাওয়া সম্ভব? প্রযুক্তির এই যুগে বিষয়টি রীতিমতো অসম্ভব মনে হলেও এক সময় নৌকা ছিল বাঙালি মুসলমানের হজে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। এর বিকল্প হিসেবে কিংবা সামর্থ না থাকায় কেউ কেউ পায়ে হেঁটেও হজ করতে গিয়েছেন- এমন নজির আছে। তবে নৌকা অথবা জাহাজে হজে যাওয়া ছিল সেই যুগে সাধারণ বিষয়।

উপমহাদেশের মুসলমান কিংবা বাঙালি মুসলমান একসময় হজে যেতেন জাহাজে চেপে। বোম্বে (এখন মুম্বাই) কিংবা করাচি গিয়ে তারপর তারা উঠতেন জাহাজে। অনেক সময় বিরূপ আবহাওয়ায় যাত্রাপথেই জীবনের সমাপ্তি ঘটতো। যাইহোক, এভাবে ওই পথে যারা হজে যেতেন তাদের বলা হতো ‘পাকিস্তানি হাজি’ বা ‘বোম্বাই হাজি’। সেকালে হজের স্বপ্ন পূরণ হতো হাতে গোনা কিছু মানুষের, যাদের অর্থবিত্ত ছিল, শরীরে শক্তি ছিল আর ছিল দৃঢ় মনোবল। বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবের ছিল যে, একারণে গ্রামের কেউ হজ করার ফলে সেই গ্রামের পুরোনো নাম পালটে ‘হাজিপুর’, ‘হাজিগঞ্জ’, ‘হাজিপাড়া’ ইত্যাদি রাখা হতো। বৃদ্ধ মানুষের হজে যাওয়া প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ এক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘আমাদের অঞ্চলের লোকজনই বয়স হলে হজে যায় অথচ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ছেলেমেয়েরা বিয়ের সাথে সাথেই হজ করতে যায়। কী যে দারুণ লাগে দেখতে!’

 

জেদ্দা সমুদ্রবন্দরে নামছেন হজযাত্রীরা, ছবি: সংগৃহীত

 

বাঙালি হাজিদের মধ্যে খান বাহাদুর আহছানউল্লা ‘আমার জীবনধারা’ গ্রন্থে হজে যাওয়ার বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘আমি করাচি বন্দরে গিয়ে জাহাজে উঠি। জাহাজের প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণি ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণি ছিল না। প্রথম শ্রেণির টিকিটের দাম ৪৫০ টাকা। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জাহাজের দোতলায় থাকার জায়গা দেওয়া হলো। আমাদের সঙ্গে প্রচুর চাল, ডাল, ঘি, চিনি ও চা ছিল। আমাকে রান্নার ভার দেওয়া হলো। আমি দুপুরে খিচুড়ি রাঁধতাম। মঞ্জিলে মঞ্জিলে কেবল জ্বালানি কাঠ ও পানি খরিদ করা হতো। পথিমধ্যে মাছ দুষ্প্রাপ্য ছিল। তবে ছাগলের মাংস পাওয়া যেত। জাহাজ সোকোট্টার (ভারত মহাসাগরে চারটি দ্বীপের একটি মালা, ইয়েমেনের অংশ) কাছে পৌঁছালে সমুদ্রের গর্জন শুরু হয়। উত্তাল তরঙ্গে জাহাজ দুলে ওঠে। আমাদের কামরার কাচের সব বাসনপত্র ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অন্ধকারের ভেতর আমি হাঁটু গেড়ে জাহাজের শিকল ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। ডেকের যাত্রীরা বমি ও মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়।’

হজ প্রসঙ্গে অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম। তিনি ‘সমুদ্রপথে হজ গমন অভিজ্ঞতা’ শিরোনামে একটি গদ্যে লিখেছেন: ‘নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও মাঝে মাঝে সমুদ্রযাত্রা সুখকর হয়ে উঠত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে। জাহাজ সাধারণত উপকূল থেকে কিছুটা দূরে দিয়ে যায়। রাতে উপকূলে অনেক বিজলি বাতি নজরে পড়লে বোঝা যেত যে কোন নগরী অতিক্রম করা হচ্ছে। বিভিন্ন শহর-নগর অতিক্রমকালে মাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হতো। বঙ্গোপসাগরে সূর্যাস্তের সময় হাজার হাজার হাঙর দেখা যেত। বিরাট আকারের তিমি ভেসে উঠত জাহাজের কাছে এসে। উড়ুক্কু মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে কখনো পড়ত জাহাজের পাটাতনে। সে ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।’

তবে হজ শুরু করার আগে থেকেই উপমহাদেশের মানুষ জেদ্দা বন্দর সম্পর্কে জানতেন। ভারতীয় বণিকরা মসলা, মুক্তা, মূল্যবান পাথর, রেশম, চন্দন কাঠ ও সুগন্ধি বোঝাই জাহাজ ভেড়াত জেদ্দা বন্দরে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতীয়দের হজ করতে জেদ্দায় পদার্পণের ইতিহাস শুরু হয় মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়কালে (৬৬৪ থেকে ৭১২)। এরপর মোগল আমল থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের মানুষের হজে যাওয়ার রাস্তা ছিল দুটি। স্থলপথে উত্তর-পশ্চিম ভারত অতিক্রম করে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান ও ইরাক হয়ে সৌদি আরব। এটি ছিল খুব কষ্টকর এবং বিপজ্জনক। আরেকটি ছিল বঙ্গোপসাগর-ভারত সাগর-লোহিত সাগর হয়ে সৌদি আরব পৌঁছানো। এই জলপথ ছিল বেশি জনপ্রিয়। তবে এ পথেও বিপদ ছিল। ষোলো শতকে হাজি ও বণিকদের পর্তুগিজদের কাছ থেকে ‘কার্তাজ’ নামে একটি পাস সংগ্রহ করতে হতো। এটি যথেষ্ট কঠিন কাজ ছিল। এই জটিলতা এড়াতে মোগল সম্রাটের ওলামারা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন- এ পর্যায়ে হজের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সুদিনে মোগল শাসকরা হজযাত্রীদের জন্য সবরকম সুব্যবস্থা করতেন। তারা কয়েকটি জাহাজ মিলিয়ে একটি নৌবহর তৈরি করতেন। যাত্রীদের যাওয়া, থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

 

মিনার ময়দানে রান্নার আয়োজন, পেছনে তাঁবুর সারি, ছবি: সংগৃহীত

 

গুজরাটের সুরাটকে সেকালে বলা হতো ‘বাব-আল মক্কা’ বা বন্দরে মোবারক। ভারতীয় হজযাত্রীদের জন্য এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সম্রাট আকবরই ছিলেন প্রথম মোগল শাসক, যিনি সরকারি খরচে কিংবা ভর্তুকি দিয়ে হজযাত্রার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি হাজিদের জন্য মক্কায় একটি সেবাদানকেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। ১৫৭৫ সালে পর্তুগিজদের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে আকবর প্রতিবছর একটি হজ নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দেন। পরিব্রাজক জন ফ্রেয়ার কিয়ানি ওরফে হাজি মোহাম্মদ আমিন-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, জাহাজগুলোর ওজন ছিল ১৪০০ থেকে ১৬০০ টন এবং যাত্রী পরিবহন করতে পারত প্রায় সতেরোশ। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। জাহাঙ্গীরের সময় ১৬১৩ সালে রহিমি নামে একটি জাহাজ কার্তাজ নেওয়া সত্ত্বেও পর্তুগিজদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইউরোপের লোকজনও জানত যে রহিমি তীর্থযাত্রায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ। জাহাজটি আক্রান্ত হওয়ায় মোগল সম্রাট খুব অসম্মান বোধ করেন। ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ এই তত্ত্ব অনুসারে জাহাঙ্গীর ব্রিটিশদের প্রতি নরম হন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি দেন। যা পলাশীর যুদ্ধেরও একটি প্রেক্ষাপট রচনা করে। বিখ্যাত লেখক কাজভিনি তাঁর হজ যাত্রা পথের বিবরণ দিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। নাম ‘আনিস আল হজ’। মোগল শাসকরা সরকারি খরচে ষড়যন্ত্রকারীকেও হজে পাঠাতেন। এমনকি কাউকে নির্বাসন দিতে চাইলেও হজে পাঠিয়ে দিতেন। আকবর যেমন বৈরাম খানকে পাঠিয়েছিলেন। কারণ বৈরাম খান তার শাসনেও হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন যা তাঁর কাছে তখন অসহ্য ঠেকেছিল। সেটি ১৫৫৩ সালের কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বৈরাম খান সুরাট যাওয়ার পথে আহমেদাবাদে একজন আফগান কর্তৃক নিহত হন। জাহাঙ্গীর ভুল চিকিৎসার জন্য তাঁর পারসিয়ান হেকিম সাদরাকেও মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবও তাঁর একজন কাজীকে বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন এবং হজে পাঠিয়েছিলেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, মোগল বাদশাহরা হাজার হাজার লোককে হজ করতে পাঠালেও নিজেরা কখনো হজে গেছেন এমন জানা যায় না। তবে খুব সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মধ্যে আকবরের ফুপু অর্থাৎ বাবরের কন্যা গুলবদনের নাম পাওয়া যায়। তিনি হজ করেছিলেন ১৫৭৬ সালে। আর সম্রাজ্ঞী হিসেবে প্রথম হাজি খেতাব পেয়েছেন ভূপালের সিকান্দার বেগম। ১৮৬৩ সালে। তিনি ১৫০০ সঙ্গী নিয়ে পুরো একটি জাহাজ রিজার্ভ করে হজে যান। সঙ্গীদের অন্যতম ছিলেন তাঁর মা কুদসিয়া বেগম। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের নির্ধারিত হজ এজেন্সি ছিল টমাস কুক অ্যান্ড সন্স। টমাস কুক এজেন্সি রেলপথ, নৌপথ, পাসপোর্ট, টিকিটিং, চিকিৎসা ইত্যাদি সব কিছুর দায়িত্ব পেয়েছিল। ১৯২৭ সালে বোম্বের পুলিশ কমিশনার ডি. হিলির নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি হজ কমিটি গঠিত হয়েছিল। ১৯৫৯ পর্যন্ত এ রকম কমিটি কার্যকর ছিল। ১৯৫৯ সালে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ১০ রুপি ও ১০০ রুপির বিশেষ হজ নোট চালু করে। এগুলোর নম্বর শুরু হতো এইচএ দিয়ে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানও হজ নোটের প্রচলন ঘটিয়েছিল।

 

১৯৫৩ সালে পবিত্র কাবা শরিফে হাজি সাহেবদের তাওয়াফের দৃশ্য, ছবি: সংগৃহীত

 

এত কষ্ট করে প্রায় ছয়-সাতমাস পর জমজমের পানি আর মদিনার খেজুর নিয়ে কোনো এক সন্ধ্যায় হজ থেকে ফিরে আসতেন হাজিরা। পরিবারে তখন আনন্দের বন্যা বইয়ে যেত। নতুন হাজি ফিরেছেন শুনলেই পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো হতো তাঁকে দেখতে। দূর থেকেও মানুষ আসত। চাঁদের আলোয় উঠানে পাটি বিছিয়ে তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ শুনত মক্কা মদিনার গল্প। আর এভাবেই সেইসব সৌভাগ্যবান মানুষের কল্যাণে গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ত হজের অপূর্ব ভ্রমণাখ্যান।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়