ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘ভয়াল ১২ নভেম্বর’ এর ৫১ বছর

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ১২ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১০:৫৩, ১২ নভেম্বর ২০২১
‘ভয়াল ১২ নভেম্বর’ এর ৫১ বছর

ভয়াল ১২ নভেম্বর ১৯৭০ : ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংসযজ্ঞের পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ‘ভয়াল ১২ নভেম্বর’ আজ। ১৯৭০ সালের এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরান জনপদে পরিণত হয়। 

এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতায় আজও অনেকে শিউরে ওঠেন। ওই ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ভোলা এবং তৎকালীন নোয়াখালী উপকূলে।  তৎকালীন নোয়াখালী উপকূলের রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ এবং পটুয়াখালী পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।

সেই স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে রয়েছেন কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন, কেবল তারাই অনুভব করেন সেদিনের ভয়াবহতা। ধারণা করা হয়, সেই দুর্যোগে ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেদিন উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয় লাশের নদীতে। এজন্য একে ‌‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়ে থাকে।

সত্তরের সেই ভয়াবহ সাইক্লোনের কালো রাতের কথা মনে হলে ধূসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেন ভোলার দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদিপশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। জনশূন্য হয়ে পড়েছিল দ্বীপ ভোলা।’

সেই সময়কার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলার সমস্ত জনপদ বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল আর নদীতে গবাদিপশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়ে ছিল। তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন ছিল ‘বাংলার মানুষ কাঁদো ॥ ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ’। আর এ সংবাদ বিশ্ব জানতে পেরেছিল চার দিন পর। সেই চিত্রটি আজও ঢাকা প্রেস ইনস্টিটিউট-এ কালের সাক্ষী হিসেবে বাঁধানো রয়েছে।

সত্তরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে যান, এসব দৃশ্য দেখে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন।

প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এম সানাউল্লাহ্ নূরী তখন দৈনিক বাংলায় (প্রাক্তন দৈনিক পাকিস্তান ) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি লেখেন, (সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর)  ‘আমরা  রামগতি বাজারের নিকটবর্তী চর এলাকায় পৌঁছালাম। সেখানে স্তূপীকৃত লাশ এবং মৃত গবাদিপশুর যে হাল দেখলাম, তা ভাষায় অবর্ণনীয়। রামগতি বাজারের একজন শৌখিন ফটোগ্রাফার আমাকে ফুলের মতো ফুটফুটে চারটি শিশুর ছবি দিয়েছিলেন। সেটি আমি ছেপেছি দৈনিক বাংলায়।’

 তিনি আরো লেখেন, ‘আমি আমার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে থেকে একটানা কয়েক দিন ঢাকায় দৈনিক বাংলার জন্য রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলাম। এতে কাগজের প্রচার সংখ্যা ত্রিশ হাজার থেকে এক লাখে উঠেছিল। চট্টগ্রামে সে সময় এক টাকা দামের কাগজ পাঁচ-ছয় টাকা বিক্রি হচ্ছিল। আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধানক্ষেতগুলোতে  নাকেমুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ও পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে। গোটা উপকূল অঞ্চলে প্রায় অর্ধকোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছে। ১২৮৩ সালের গোর্কির চেয়ে বহুগুণে করুণ এবং ভয়াবহ ছিল ’৭০ সালের গোর্কি। এর ধ্বংসলীলা তো আমরা নিজের চোখেই দেখেছি। সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হয়েছিল এই প্রলয় ভয়াল দুর্যোগের খবর।’

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এ বছর সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ৫১ বছর পূর্ণ হয়েছে। ভয়াল সেই ঝড়ের অর্ধশতাব্দী পর উপকূলের মানুষ এখনও অরক্ষিত, অবহেলিত। 

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়