ঢাকা     সোমবার   ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ২৭ ১৪৩১

৭ মার্চের সেই মাইক্রোফোন আগলে রেখেছে কল-রেডী 

মুজাহিদ বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৬, ৭ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১২:৪২, ৭ মার্চ ২০২২
৭ মার্চের সেই মাইক্রোফোন আগলে রেখেছে কল-রেডী 

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের অমর উবাচ। এই ভাষণ সেদিন ৭ কোটি বাঙালির পথের দিশা দেখিয়েছিল। 

এটি অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের বিষয় যে, ভাষণটি এখন বৈশ্বিক সম্পদ। ইউনেস্কো এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়ে অবশ্যকর্তব্য পালন করেছে। এর আগে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সেরা ভাষণগুলো নিয়ে ‘উই শ্যাল ফাই অন দ্য বিচেস: স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার হিস্ট্রি’ নামে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করেন বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তৃতা হিসেবে। 

যে ভাষণ জাতির মুক্তির স্বপ্নে জড়িয়ে আছে; তার সঙ্গে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে আরেকটি নাম ‘কল-রেডী’। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় সাউন্ড সিস্টেমের দায়িত্ব পালন করে প্রতিষ্ঠানটি।  

আরো পড়ুন:

কল-রেডী দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোফোনের সামনে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিকগণ। কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশীদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রমূখ। 

বামে হরিপদ ঘোষ। ডানের ছবিতে অসুস্থ দয়াল ঘোষের চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছেন শেখ হাসিনা  

কল-রেডীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার ইচ্ছে ছিল ইসলামপুরে কাপড়ের পাইকারী দোকান দেবেন দুই সন্তান। কিন্তু তাদের আগ্রহ ছিল না কাপড়ের ব্যবসায়। কারণ, পুরান ঢাকায় কাপড়ের দোকানের অভাব ছিল না। দুই ভাই তখন সিদ্ধান্ত নেন বাতি ও লাইটের ব্যবসা করবেন। পুরান ঢাকার মানুষ আলোকসজ্জা পছন্দ করে, বেশ ভালো চলবে। এরপর দুজন ১৯৪৮ সালে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন। দোকানের প্রথম গ্রাহক ছিলেন স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল। ৩ টাকা অগ্রীম দিয়ে তিনি বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়ে যান দুই ভাইকে। 

কিন্তু সমসাময়িক আরও অনেক দোকান গড়ে ওঠায় শঙ্কায় পড়েন তারা। এমন সময় বুদ্ধি খাটিয়ে লাইটের পাশাপাশি ব্যবসায় সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন হরিপদ ঘোষাল। শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগলো। প্রথম দিকে ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে এসে এবং নিজেরাই হ্যান্ড মাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ভাড়া দেওয়া শুরু করেন।কিন্তু এক সময় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আনতে হয় দুই ভাইকে। 

কল-রেডী নামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল করলে যাতে তাদের প্রতিষ্ঠান রেডি থাকে এই ভাবনা থেকেই নামটি এসেছে। অর্থাৎ কল করলে মাইক পৌঁছে যাবে দ্রুত। 

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে আছেন সাগর ঘোষ, রানা ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ ও শিবনাথ ঘোষ। তারা চার ভাই। প্রতিষ্ঠানেই দেখা মিললো সাগর ঘোষের। আলাপচারিতায় ফাঁকে তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বাবার ছবি দেখাচ্ছিলেন। সাগর ঘোষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেননি। তবে বাবা-জেঠার মুখে অনেক গল্প শুনেছেন। বিশেষ করে বাবা হরিপদ ঘোষের কাছে। বঙ্গবন্ধু হরিপদকে স্নেহ করে ‘পাগলা’ ডাকতেন- বলেন সাগর ঘোষ। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং কিংবা তার আশপাশে এলে বঙ্গবন্ধু হরিপদের খোঁজখবর নিতেন জানা গেলো সে কথাও।  

৭ মার্চের ভাষণের আগের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাগর ঘোষ জানান, ৭ মার্চের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ডেকে নেন। তিনি রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগানোর নির্দেশ দেন। এ সময় দুই ভাই জানতে চান কত মাইক লাগাতে হবে? বঙ্গবন্ধু সেদিন সংখ্যাটা বলেননি। উদীপ্ত কণ্ঠে নির্দেশ দেন- যতো পারো ততো, বলেন সাগর ঘোষ। এরপর একশোর অধিক মাইক লাগানো হয় জনসমাবেশ স্থলে। সমাবেশের তিনদিন পূর্ব থেকেই রাতের আঁধারে মাইকগুলো প্রস্তুত রাখার কাজ শুরু করে কল-রেডী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুদ রাখা হয়। সে সময় পাকিস্তানি শাসকের ভয় উপেক্ষা করে কাজ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।  

৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড ব্যবহার করেন বর্তমানে কল-রেডীর কাছে সংরক্ষিত আছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে সেসব হস্তান্তর করবেন বলে জানান সাগর ঘোষ। তবে তিনি সেগুলো এই প্রতিবেদককে দেখাতে বা সেগুলোর কোনো আলোকচিত্র দেখাতে রাজী হননি। সাগর ঘোষ বলেন, ‘ইতিহাসের অংশ আমাদের এই প্রতিষ্ঠান। খুব গর্ব হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাইকে কথা বলে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন- এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে! আমরা সেই মাইক্রোফোন সংরক্ষণ করে রেখেছি। চাইলে যে কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেব। কেননা এগুলো আরো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।’ 
 

/তারা/ 

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়