ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

বট গাছটি এখনও আছে কিন্তু কতো দিন থাকবে?

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪১, ৩০ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৭:০৬, ৬ এপ্রিল ২০২২
বট গাছটি এখনও আছে কিন্তু কতো দিন থাকবে?

একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত সেই বটগাছ

বটগাছ। মাথার উপর ছায়ার প্রতীক। অনেক সময় বটগাছ হয়ে ওঠে ইতিহাসের আশ্রয়। রায়েরবাজারে তেমনই একটি বটগাছ বহন করছে একাত্তরে পাকসেনা কর্তৃক হত্যাযজ্ঞের নির্মম স্মৃতি। শহিদদের মৃত্যুর আগে এই বটগাছে বেঁধে বা ঝুলিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো বলে জানা গেছে। সেই মর্মন্তুদ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী বটগাছটি আজ দখলদারের কবলে। 

রায়েরবাজার বধ্যভূমি। এর বুকে শোকচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। সৌধের ঠিক পূর্বদিকেই বট গাছটির অবস্থান। কতদিন গাছটি স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কেউ জানেন না। কারণ অনেকের অভিযোগ রাতের আঁধারে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছের ডাল। চারপাশে অনেক আগেই গড়ে উঠেছে দোকানপাট, বাড়ি। সচেতন এলাকাবাসীর দাবি এখনই গাছটি বাঁচানোর উদ্যোগ না নিলে কিছুদিনের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে ইতিহাসের এই চিহ্ন।

স্থানীয় বাসিন্দা, লেখক রবিউল আলম (৬৫)। ছেলেবেলায় রবিউল আলমের থাকার ঘর ছিল বটগাছটির নিকটেই। তিনি বলেন, ‘একাত্তর সালে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য ক্যাম্প থেকে এই পথেই তাদের ধরে নিয়ে যেত। রাতের আঁধারে একাধিক বুদ্ধিজীবীকে টেনে হিঁচড়ে এই বটগাছের নিচে আনা হয়েছে। এখানেই চলতো তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন। অনেক বুদ্ধিজীবীর জীবনাবসান হয়েছে রায়েরবাজারের এই বটগাছের নিচে।’

সে সময় রবিউল আলম কিশোর। তার দাবি তিনি অনেক কিছু দেখেছেন, শুনেছেন। ‘১১ ডিসেম্বরে ক্ষুধার তাড়না সহ্য করতে না পেরে লাউতলা খালের পাশে বিলে মাছ ধরতে গিয়ে আমিসহ চারজন ইউনূস চেয়ারম্যানের ইটের খোলার একটু ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে দেখি শত শত মানুষের লাশ। শিয়াল কুকুর লাশগুলো টানাটানি করছে। দেখে আমি চিৎকার দিয়েছিলাম। চিৎকার শুনে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। প্রতি উত্তরে আমরা গুলি ছুড়ছি না দেখে ওরা এগিয়ে আসে। আমাদের ধরে নিয়ে যায়। অমানুষিক নির্যাতন করে। পরে ছেড়ে দেয়।’ বলেন রবিউল আলম।

বইমেলায় নিজের লেখা বই বিক্রি করছেন রবিউল আলম 

এরপরই মূলত সচেতন হয়ে ওঠেন তিনি। রবিউল আলম বলেন, ‘এই ঘটনার পর থেকে প্রতিদিনি খেয়াল করি এই বটগাছের নিচ থেকে রাতে আর্তস্বর, গোঙ্গানী আর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বটগাছটি তখন ছিল রহিম ব্যাপারী ঘাটের পাশে শান বাঁধানো। নিচু জমি। এই জায়গায় তেমন কেউ আসতো না। নারী নির্যাতন করার জন্যও জায়গাটি ছিল নিরাপদ। এ জন্য ওরা এই জায়গাটি বেছে নিয়েছিল। ৮ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বটগাছে বেঁধে বা ঝুলিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করার সময় তাদের আর্তচিৎকার, কান্না আমি শুনেছি।’

রবিউল আলম আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আগামী ১৪ ডিসেম্বর আসার আগে বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি বহনকারী বটগাছটি উদ্ধার করতে পারবো আশাকরি। শহিদ সন্তানদের জন্য এটি হবে উপহার। 

স্থানীয়রা জানালেন গাছটির বছস ২৫০-এর বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন। বটগাছ এবং এর চারপাশ এখন এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে। যদিও স্থানীয় কাউন্সিলরের ভাষ্য ভিন্ন। রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে গাছের ডাল। অর্থাৎ একটু একটু করে গাছটি নিশ্চিহ্ন করে দেবার পায়তারা। ডাল কেটে আলকাতরা ও কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখারও চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক গাছটি দখল মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ দখল মুক্ত হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। এরপর আর তেমন অগ্রগতি হয়নি বলে জানান রবিউল।

গাছটির ইতিহাস জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও একাত্তরের গণহত্যা বিষয়ক গবেষক তপন কুমার পালিত বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সঙ্গে এমন একটি গাছের কথা আমার জানা নেই। তবে এটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেহেতু গাছটি পুরোনো তাই সংরক্ষণ করা উচিত। গাছটি নিয়ে এলকাবাসীরও মত নেওয়া উচিত।’ 

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এমন একটি বই আমি পড়েছি। তবে বাংলা একাডেমির ‘স্মৃতি ১৯৭১’-এ এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। তাছাড়া ইতিহাস লেখা হয়েছে সেখান থেকে যারা ফিরে এসেছেন তাদের ভাষ্য মতে। কিন্তু যিনি বইটি লিখেছেন তার বয়স সে সময় ১২-১৩ বছর ছিল। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। এমনটা হতে পারে।’ 

উল্লেখ্য রবিউল আলম ‘আমার দেখা রায়েরবাজার বধ্যভূমি এবং শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তেভেজা একটি বটগাছ’ গ্রন্থে সে সময়ের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মাদ হোসেন বলেন, ‘যিনি এমন বলে বেরাচ্ছেন তিনি আসলে ইতিহাস বিকৃত করছেন। এমন কোনো ঘটনার সঙ্গে বটগাছটির সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ যেহেতু এটি পুরোনো গাছ তাই সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু ১৯৯৮ সালে অগ্নিকান্ডে গাছটির ক্ষতি হয়। এজন্য আমরা কিছু ডালপালা কেটে দিয়েছিলাম।’

দখল করার বিষয়ে এই কাউন্সিলর বলেন, ‘গাছের আশপাশের জমি মানুষের। সেখানে দোকান ও বাসা বাড়ি আছে। গাছের যেটুকু জায়গা সেটুকু ঠিকই আছে।’

তবে ভিন্ন কথা বলছেন স্থানীয় প্রবীণরা। যদিও তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে বটগাছটি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধা নাদির খান বলেন, ‘এই বটগাছের কথা স্মরণ হলে এখনও কান্না ধরে রাখতে পারি না। বটগাছসহ এই এলাকার অধিকাংশ জমি ছিল পাল সমিতির। বটগাছের নিচেই হিন্দুদের শীতলা পূজা হতো। বটগাছের পাশেই ছিল একটি পুকুর। একে ‘কালিশাহ’র পুকুর’ বলা হতো। এখনও ভূমি অফিসে খুঁজলে আমার কথার সত্যতা পাবেন। তবে এখন বটগাছের জমি কাগজে-কলমে পাল সমিতির থাকলেও দখলে নাই।’

‘জমিগুলো সেসময় নব্যধনী শাওকত সাহেব কীভাবে যেনো ধীরে ধীরে দখল করেছেন’ অভিযোগ করেন নাদির খান। 

এই মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ২২ বছর। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। ডিসেম্বরের শুরুতে আমার বসিলা ক্যাম্পে চলে আসি। তখন রায়ের বাজার এলাকা থেকে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত গোলাগুলির আওয়াজ পেতাম। আমার এক ভাইয়ের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, এখানে অনেক লোককে ধরে এনে গুলি করে মারা হয় আর বটগাছে ঝুলিয়ে বা বেঁধে রাখে।’

স্বাধীনতার সুবাস তখন পাওয়া যাচ্ছিল। সময় বয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। যে কারণে এ বিষয়ে আর ভাবার সময় পাননি নাদির খান। তবে তিনি চমকে ওঠেন স্বাধীনতার পর সেই বট গাছের নিকটে গেলে। নাদির খান বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘গিয়ে দেখে অসংখ্য মানুষের লাশ পড়ে আছে। আম কাঠাল পাঁকলে যেভাবে গাছে ঝুলে থাকে তেমনি অনেককেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে গাছের ডালে। মহিলাদের অনেকের দেহে কাপড় নেই। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অমানবিক নির্যাতনের চিহ্ন। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পুকুরের পাশে ১৩০ জনকে গণকবর দিয়েছি। এখন সেই কবরের উপরে বাড়ি হয়েছে, দোকান হয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধের পর এই পুকুরের ধারে ও বটগাছের নিচে বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে উল্লেখ করে নাদির খান আরো বলেন, ‘সিরাজউদ্দৌলা, সূর্যস্নান দেখলে এখনও সেই দৃশ্য পাবেন। এরপর মানুষ বাড়তে থাকে এই এলাকায়। রায়েরবাজার এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। তারা চলে যেতে থাকলে মুসলমানরা সেগুলো দখল করে নিতে থাকে। পুকুরটিও ভরাট হতে থাকে। পরে এরশাদের আমলে বেড়িবাঁধ হলে পুকুর অকার্যকর হয়ে পড়ে। ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়।’

‘এখন এই বট গাছের নিচে মানুষ ব্যবসা করে খাচ্ছে। ভাই আপনারা একটু বলেন, গাছটি যেন সংরক্ষণ করা হয়।’ আকুতি ঝরে পড়ে এই মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠে। 

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়