ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৪ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:১১, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪
ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি

জঙ্গলবাড়ি দুর্গটি কে নির্মাণ করেছিলেন কিংবা কবে নির্মাণ করা হয়েছে এর কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এই দুর্গের ইতিহাস বাংলার বার ভুঁইয়াদের প্রধান নেতা ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত এক অধ্যায়। ১৩১৬ সনের ভূমিকম্পে দুর্গটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু বিলীন হয়ে যায়নি। এখনও এর স্থাপত্যরীতি পর্যটক ও ইতিহাস প্রেমীদের নিয়ে যায় মুঘল সৌন্দর্যের কাছে। আমার মূল পরিকল্পনা ছিল কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ যাবো। ওখানে চামড়া নদীবন্দর দেখে আসবো। যাওয়ার পথে জঙ্গলবাড়ি পড়ে। এমন ঐতিহাসিক নিদর্শনের কাছে এসে না দেখে ফিরবো! এমনটা হতেই পারে না।

হাজির হলাম জঙ্গলবাড়িতে। একটা বিষয় ভালো লেগেছে, সেখানে গিয়ে অনেক তরুনকে দেখলাম। তারাও ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দেখতে এসেছে। ওখানে একজন নিজেকে ঈশা খাঁর অধস্তন ১৫তম উত্তরাধিকার দাবি করেন। উনার নাম জামাল দাদ খান। উনিই এখন জঙ্গলবাড়িতে থাকেন। বাড়িটি ঘুরে দেখালেন জামাল দাদ খান। জানালেন নানা তথ্য। 

জানা যায়, বাংলার বার ভুঁইয়াদের প্রধান নেতা ঈশা খাঁ এই জঙ্গলবাড়িকে দ্বিতীয় রাজধানীতে রূপান্তর করেছিলেন। আফগানিস্তান থেকে প্রথমে ত্রিপুরা এসেছিলেন ঈশা খাঁ। মুঘল ও ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাংলার জমিদারগণ তাকে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে বাংলায় আসার সংবাদ পাঠালে তিনি ১৪০০ ঘোড়সওয়ার, ২১টি নৌবহর ও গোলাবারুদ নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছেছিলেন। ১৫৮৫ সালে তৎকালীন কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দুর্গ দখল করেন। সেই থেকে দুর্গের সঙ্গে মিলে মিশে গেছে ঈশা খাঁর গৌরবময় ইতিহাস। এই দুর্গ থেকে পরে তিনি একে একে সোনারগাঁওসহ মোট ২২টি পরগণা দখল করেন। 

কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা বা ঈশা খাঁর কেউ এই দুর্গের স্থপতি নয় বলে জানা যায়। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এটি প্রাক-মুসলিম যুগে নির্মিত দুর্গ। তবে ঈশা খাঁ দুর্গ দখলের পর দুর্গের ভেতরে বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেন। দুর্গটির ভেতরে রয়েছে প্রাসাদ প্রাচীর। এটি উত্তর-দক্ষিণমুখী লম্বা ইটের পাঁচিল। এর দুই পাশে দুটি চত্বর রয়েছে। আরও আছে 'করাচি' নামে একটি পূর্বমূখী একতলা ভবন ও 'অন্দর বমহল' নামে এক তলা দক্ষিণ মুখী একটি ভবন। ইটের দেওয়াল চুনকামের লেপন করা। দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে গভীর পরিখা। এটি পূর্বদিকে নরসুন্দা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। ঈশা খাঁর সময়ের দিঘী রয়েছে। দীঘির পাশে তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত  তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটা মসজিদ দেখলাম। সেখানে মুসল্লিরা এখনও নামাজ আদায় করেন। দুঃখের বিষয় মসজিদটি সংস্কার করার নামে এর প্রকৃতরূপ অনেকাংশে নষ্ট করা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন সম্প্রতি বানানো হয়েছে। সেই সময়কার ছাপ ফুটে ওঠেনি। প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের পাশেই ঈশা খাঁর বংশধরদের বাঁধানো কবর। ২০০৫ সালের ১২ জুন দুর্গের ভেতরের দরবারগৃহটি সংস্কার করে স্থানীয় প্রশাসন 'ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার' স্থাপন করে। সেখানে ঈশা খাঁর বিভিন্ন ছবি, তার বংশধরদের তালিকা এবং বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।

জামাল দাদ খান জানালেন,জঙ্গলবাড়ির আওতায় অনেক জায়গা রয়েছে। অনেক জায়গা বেদখল হয়ে আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ওই জায়গা অধিগ্রহণ করে বিশাল কমপ্লেক্স তৈরি করবে। জামাল দাদ খান যা দেখালেন তাতে কয়েকশো একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। তার ভাষ্যমতে, বাড়ির যেটুকু অংশ নিজেরা ব্যবহার করছেন সেটুকু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রজেক্টে দেবেন না। 

বর্তমানে এ বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধদপ্তরের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর এ বাড়িটির বা দুর্গের ঐতিহাসিক ও আদি ভাব-গাম্ভীর্য রক্ষা করবে এটাই প্রত্যাশা।

/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়