পদ্মার নাচন কথা
তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশ এক ঋদ্ধ ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনার দেশ। এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা পরিবেশনা লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো পরিবেশনা ধর্মীয় কৃত্যমূলক, আবার কোনো কোনো পরিবেশনা ধর্মীয় কৃত্যের উত্তরণ ঘটিয়ে এক সমন্বয়বাদী পরিবেশনায় রূপ নিয়েছে। তেমনি একটি পরিবেশনা ‘পদ্মার নাচন’। এই পরিবেশনা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার নওদা বহলবাড়িয়া ইউনিয়নের রেজাউল হক সলক।
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা, মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মনসামঙ্গলের কাহিনি অবলম্বনে ‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশিত হয়। ‘পদ্মার নাচন’ নৃত্য, গীত, বর্ণনা এবং সংলাপ ও প্রতিসংলাপের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। এই পরিবেশনায় নৃত্যের প্রভাব বেশি। নৃৃত্যের ক্ষেত্রে ছুুকরিগণ মূল ভূমিকা পালন করে। সাধারণত পদ্মার নাচন মানতের পালা, মানতের জন্য এই পালা আয়োজিত হয়। রোগ ও বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এই পালা আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে ঘা হলে তা থেকে মুক্তির জন্য পদ্মার নাচন আয়োজন করা হয়। আবার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অনেকে এই পালা আয়োজন করে থাকেন।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই পরিবেশনার প্রচলন সম্পর্কে রেজাউল হক সলক বলেন, “পাবনা থেকে এই পরিবেশনা কুষ্টিয়াতে নিয়ে আসেন মিরপুরে কেউপুর গ্রামের রিয়াজউদ্দিন মালিথা। আবার কারো মতে, এই অঞ্চলে পদ্মার নাচন প্রবর্তন করেন লাল চাঁদ ও কালা চাঁদ। বংশ পরম্পরায় এই পরিবেশনা কুষ্টিয়া অঞ্চলে পরিবেশিত হয়। বর্তমানে রিয়াজউদ্দিন মালিথার বংশধরদের মধ্যে হোসেন আলী ও চঞ্চল ফকির এই পরিবেশনা অব্যাহত রেখেছেন।”
মনসামঙ্গলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা প্রচলিত। এই পরিবেশনাসমূহ হচ্ছে- ‘পদ্মপুরাণ গান’, ‘রয়ানি’, ‘মনসার পাঁচালি’, ‘ভাসান গান’, ‘বিষহরির গান’, ‘বেহুলার নাচারি’, ‘ভাসান যাত্রা’, ‘মনসার ভাসান যাত্রা’ ইত্যাদি। বাংলা মঙ্গলকাব্যসমূহের মধ্যে মনসামঙ্গল সবচেয়ে প্রাচীন পরিবেশনা। অনার্য দেব-দেবীর আখ্যানমূলক পরিবেশনা ‘মঙ্গলকাব্য’ নামে পরিবেশিত হয় বাংলার মুসলিম বিজয়ের পর। ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত প্রায় পাঁচশ বছর মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত ও পরিবেশিত হয়। এ ধারার আদিকবি কানা হরিদত্ত। ত্রয়োদশ শতকের শেষ ভাগ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন বলে গবেষকরা মনে করেন।
‘পদ্মার নাচনে’র পুরো পালার জন্য সাতরাত সাতদিন সময় প্রয়োজন। পরিবেশনাটি সাত পর্বে বিভক্ত। পর্বসমূহ হলো:
১. শিব ও পার্বতীর পালা
২. পদ্মার পালা
৩. বাজার পালা
৪. বিয়ের পালা
৫. মৃত্যুর পালা
৬. ঘাটের পালা ও জিয়দানের পালা
‘শিব ও পার্বতীর পালা’ অংশে শিব মুগ্ধ হয় দুর্গার রূপে। এই মুগ্ধতার ফলে নিজ বীর্য পদ্মপাতায় রেখে দেন। বাসুকী সে পদ্মপাতা থেকে গর্ভবতী হয়। জন্ম নেয় মনসা। ধ্যানমগ্ন শিবের সামনে নৃত্য করে মনসা। শিবের ধ্যান ভঙ্গ হয়, মনসার রূপে মুগ্ধ শিব তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পদ্মা জানায় যে, সে শিবকন্যা। শিব তখন পদ্মাকে লুকিয়ে রাখে ধ্যানঘরে। পার্বতী খুঁজে বের করে পদ্মাকে, কন্যা তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু সৎ মা পদ্মার বাঁ চোখ শূলের আঘাতে কানা করে দেয়। পার্বতীর কথায় শিব নিজ কন্যাকে বনবাসে পাঠায়। এ সময় কালীদহ বিষাক্ত হয়। ফলে শিবের সারা শরীর বিষাক্ত হয়। পদ্মা সুস্থ করে দেয় শিবকে। পিতার কাছে দেবীর আসন চায়, তখন শিব কন্যাকে বলে, যদি সে চাঁদ সওদাগরের পূজা আনতে পারে তবে তার উদ্দেশ্য সফল হবে।
‘পদ্মার পালা’ অংশে পদ্মা পূজা আনতে যায় চাঁদ সওদাগরের কাছে। কিন্তু শিব ভক্ত চাঁদ মনসাকে পূজা না দিয়ে ‘কানি’, ‘ব্যাঙ খাকি’ বলে অপমান করে। চাঁদ ও তার ছয়পুত্রসহ বাণিজ্যের তরি ডুবিয়ে দেয় পদ্মা। চাঁদ সওদাগর বেঁচে ফিরে আসে। সায়মন বেনের ঘরে জন্ম নেয় বেহুলা এবং চাঁদ সওদাগরের ঘরে জন্ম নেয় লখিন্দর।
তৃতীয় পালা ‘বাজার পালা’। ছদ্মবেশী পদ্মার পরামর্শে লখিন্দর নিছানী নগরে ইছামতীর তীরে নবরত্ন বাজার স্থাপন করে। উল্লেখ্য, বাজারটি সায়মন বেনের ছিল, এই অচল বাজার তাঁর অনুমতি নিয়ে পুনরায় সচল করা হয়। মনসা কৌশল করে বেহুলাকে সে বাজারে নিয়ে যায়। বেহুলা পুতুল কিনতে আসে, মুগ্ধ হয় লখিন্দর। সে বিয়ে করতে চায় সায়মন বেনের কন্যাকে।
‘বিয়ের পালা’ পর্বে লখিন্দরের কথা সনেকা জানায় স্বামীকে। সওদাগর ঘটক পাঠায় সায়মন বেনের কাছে। সায়মন প্রথমে রাজি হয় না। চাঁদ সওদাগর নিজে সায়মন বেনের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়। অবশেষে তিনি বিয়েতে সম্মতি দেন। মহাধুমধান করে বিয়ে হয় লখিন্দর ও বেহুলার।
‘মৃত্যুপালা’ হয় সাধারণত পঞ্চম রাতে। বেহুলা ও লখিন্দরের জন্য লোহার বাসরঘর নির্মাণ করা হয়। বেহুলার স্বামীকে বিয়ের রাতে কালনাগিনী দংশন করে। লোহার বাসর ঘর থেকে যাবার সময় বেহুলা তার লেজ কেটে রাখে। সকাল হলে বিভিন্ন স্থান থেকে ওঝা ডাকা হয়। কেউ লখিন্দরকে বাঁচাতে পারে না।
ষষ্ঠ পালার নাম ‘ঘাটের পালা’। চাঁদ সওদাগরের কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে বেহুলা মৃত স্বামীকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে চলে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেহুলা একে একে উদাসিনী ঘাট, কাকের ঘাট, শিয়াল শকুনের ঘাট, গোদার ঘাট ইত্যাদি অতিক্রম করে ইন্দ্রের রাজসভায় উপস্থিত হয়।
‘জিয়দানের পালা’ হলো পদ্মার নাচনের সর্বশেষ পালা। দেবরাজ শর্ত দেয়, বেহুলা নাচ-গানের মাধ্যমে স্বর্গের দেবতাদের খুশি করতে পারলে তাঁর স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বেহুলার ময়ূর নাচে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র ফিরিয়ে দেয় লখিন্দরকে। একে একে তার ছয় ভাসুর জীবিত হয়। স্বামী ও ভাসুরদের নিয়ে বেহুলা ফিরে এলে শর্তানুসারে চাঁদ সওদাগর বাঁ হাতে পূজা দেয় পদ্মাকে। একই সময়ে চাঁদ সওদাগর ও সনেকা পুত্রবধূকে অসতী ভাবতে শুরু করে। সে অনেকদিন ঘরের বাইরে ছিল, সে পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয় বেহুলা।
‘পদ্মার নাচন’ পালার মধ্য দিয়ে নারী শক্তির বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। নারী হিসেবে ‘পদ্মা’ পিতার চরিত্রহীনতার সংকট বহন করে চলে। পদ্মার রূপে মুগ্ধ শিব তাকে বিয়ে করতে চায়। যখন কন্যার পরিচয় পায় তখন অবৈধ সন্তান তাই তাঁকে লুকিয়ে রাখে। আবার একই সঙ্গে পদ্মা নারী, পার্বতী তাঁকে সন্দেহ করবে স্বামীর ভালোবাসার কোনো নারী হিসেবে। শিব নিজ কন্যাকে স্ত্রীর সামনে নিয়ে যেতে সাহস পায় না। তাই শিব কন্যাকে বলে, ‘তোমার মতো কন্যা দেখে উঠবে রেগে জ্বলে/ তোমারে বিনাশ করে দেবে যমালয়ে।’ এর মাধ্যমে সমাজের নারীলোভী পুরুষের রূপ অঙ্কন করা হয়েছে এই পরিবেশনায়। এখানে পদ্মাকে মায়ের জন্য সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়। নারী হিসেবে পদ্মা যেন ভোগের সামগ্রী। নগ্ন পদ্মাকে দেখে অর্জুনের কামভাব জাগ্রত হয়। মামার কারণে গর্ভবতী হয় সে, এখানে নারীর শরীর যে পুরুষের আকর্ষণের বস্তু তা চিত্রিত করা হয়েছে। ঘায়ে আক্রান্ত শিবকে বাঁচিয়ে তোলে পদ্মা। তবে তার আগে শর্ত থাকে যে পদ্মাকে সন্তান হিসেবে মেনে নেবে পার্বতী। পিতাকে বাঁচায় পদ্মা, বিনিময়ে দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। শিব শর্ত দেয় যদি চাঁদ সওদাগর পূজা দেয় তবে পদ্মার দেবী হিসেবে অধিষ্ঠান হবে। লক্ষ্যণীয় পদ্মাকে পূজা পেতে হবে বণিক পুরুষের কাছ থেকে।
‘মনসামঙ্গল’ রচনা ও প্রচারের কালে বাংলায় মুসলমান শাসন শক্তিশালী ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় মুসলিম শাসকগণ তাই হিন্দু দেবী মনসার প্রতিষ্ঠার জন্য শাসকদের ভূমিকা থাকবে না। চাঁদ সওদাগরকে বড় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। চাঁদ সওদাগরের পূজা প্রদানের ফলে ব্যবসায়ী শ্রেণির পূজা মিলবে পদ্মার। যার ফলে পূজা আয়োজনে অর্থ সংকট হবে না। মধ্যযুগের কবি সে সময়ের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশকে বিবেচনা করেছেন। কেননা বাংলার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়ে দ্বন্দ্ব, দিল্লির শাসকদের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা বাংলা অঞ্চলের রাষ্ট্রক্ষমতাকে অস্থিতিশীল করে রেখেছিল। এই অবস্থায় ব্যবসায়ী শ্রেণিই পূজা প্রচলনে ভূূমিকা রাখতে পারে। আবার লিঙ্গীয় বিবেচনায় পুরুষের পূজাও পদ্মাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। ‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশনায় পদ্মা দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য মায়ের কোল খালি করে। সনেকা হারায় তার ছয়পুত্র ও স্বামীর নৌকা। আবার বিপরীতক্রমে বেহুলা স্বামীকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করে। তাঁর এ লড়াই শুধু মনসার বিপক্ষে নয়, একই সঙ্গে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদেহ লোভী পুরুষের বিরুদ্ধেও।
পদ্মার নাচনে প্রধান নারী চরিত্রসমূহ পদ্মা, বেহুলা ও সনেকা। সনেকা চরিত্রটি চিরায়ত বাঙালি নারীর রূপ, যেখানে মাতা, স্ত্রী দুটি রূপই দৃষ্ট। তিনি স্বামীর মঙ্গল কামনা ও স্বামীর অবর্তমানে সংসারের সকল কাজের দায়িত্ব পালন করেছেন। সন্তান জন্মের পর লখিন্দরকে বড় করেছেন। বেহুলা যখন মৃত পতিসহ ভাসতে চায় তখন সম্মতি দেয় সনেকা। মানবিকতার বিচারে মনসার বিপ্রতীপ মুখ সনেকা।
‘পদ্মা’ পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চিত কন্যা। অথচ এই কন্যা মহাদেবকে বিষমুক্ত করেন। দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বারবার চাঁদকে বিপদে ফেলেছেন, অবশ্য এর পূর্বে সতর্ক করেছেন। সওদাগরের ছয়পুত্র ও মাঝি-মাল্লাকে হত্যার মাধ্যমে এক হিংস্র নারীর অবয়ব পাওয়া যায় মনসায়। কিন্তু চাঁদ ছাড়া অন্য কারো প্রতি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় না। এই হিংস্রতাকে বিশ্লেষণ করা যায় তার জীবনের বেদনা ও নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের লড়াইয়ের আলোকে। পিতার বৈধ সন্তান নয়, তারপরও পদ্মা সমাজে প্রতিষ্ঠা চায়। চাঁদের সন্তান হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নিষ্ঠুর রূপ লক্ষ্য করা যায় বিপরীতক্রমে লখিন্দরের জন্মের জন্য সনেকাকে লাল, নীল ও সবুজ বড়ি দিয়ে যায়। নতুন প্রাণের জন্য পদ্মার প্রয়াস। জন্ম হয় লখিন্দরের, পদ্মার কারণে লখিন্দর ও বেহুলার বিয়ে হয়। পদ্মা সম্পর্কে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের প্রতিবাদী নারীত্বের কণ্ঠস্বর। তিনি পূজা প্রাপ্তি তথা নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছেন।
বেহুলা মৃত্যুকে জয় করে এনেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে বাঁচিয়ে আনতে তিনি স্বর্গ পর্যন্ত গমন করেন। অনিশ্চিত পথে তাঁর এই সাহসী যাত্রা সন্দেহাতীতভাবেই নারী হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে জ্ঞানের পথে নিজেকে নিবেদনের সমতুল্য। দেবী মনসার ক্রুরতার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন। চাঁদ সওদাগরের মতো অহং নয় তিনি স্বামী ও সম্পদকে ফিরিয়ে এনেছেন দেবরাজকে তুুষ্ট করে। পথে পথে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে, এ তার জ্ঞানের পথে যাত্রা। বেহুলা লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে এ পালায় এসেছেন। ভাইদের অনুরোধ উপেক্ষা করে স্বামীকে জীবিত করার যাত্রা শুরু হয়। বাঘ খেতে চায় মৃত লখিন্দরকে কিন্তু বেহুলা তার বদলে নিজের মাংস কেটে দিতে চায়। গোদার বাঁকে আসার পর গোদার প্রেম নিবেদন প্রত্যাখান করে বেহুলা। জুয়ারি বাঁক, ধনামনার বাঁক ও সাধুর বাঁকে বেহুলার প্রতি পুরুষের প্রেম নিবেদন। এখানে মৃতদেহসহ ভেসে যাওয়া নারীকে আপন করে পেতে চায় পুরুষ। বেহুলা একটি বাঁক পার হয় নতুন বাঁকে সংকটের মুখোমুখি হয়। বাঘ ও শেয়াল চায় লখিন্দরকে খেতে, ফলে সতীত্ব ও স্বামী রক্ষা উভয়ই তাকে করতে হয়েছে এই জলযাত্রায়। স্বামী ও ভাসুরদের ফিরিয়ে আনার পরও সুখ মেলে না বেহুলার। তাঁর সতীত্ব নিয়ে স্বজনরা প্রশ্ন তোলে। কেননা এ নারী মৃত স্বামীকে নিয়ে নদীতে ভেসেছে তাই তার সতীত্ব পরীক্ষা দিতে হবে। অবশেষে অগ্নি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। বেহুলা কোনো সংশয় না রেখে সে আগুনে ঝাঁপ দেয়।
‘পদ্মার নাচন’ পালায় দুই নারীর লড়াই সংগ্রাম ও সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে নারীর দ্রোহ প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ সময়জুড়ে এই পালা উপস্থাপিত হয় তাই একটি দলে অনেক বিকল্প পরিবেশনকারী থাকতে হয়। যেহেতু পরিবেশনকারীগণ বিভিন্ন পেশাজীবী তাই তারা নিজেদের পেশার কারণে সবগুলো পালায় অংশ নিতে পারে না। আবার দলের একজনকে সুযোগ দেওয়ার জন্য নতুুন একজনকে যুক্ত করা হয়।
পরিবেশনার জন্য বাড়ির উঠোন কিংবা বাড়ির সামনে খোলা স্থানকে বেছে নেওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও মন্দিরের চাতালে ‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশিত হয়। ‘পদ্মার নাচন’ সাধারণত সাতদিন সাতরাতের পরিবেশনা। এই পূর্ণাঙ্গ পরিবেশনাকে আয়োজনকারীর ইচ্ছা ও ক্ষমতা অনুসারে ছোট-বড় করা হয়। অনেক সময় একদিনের জন্য আয়োজন করা হয়। আবার তিনদিনের পালাও আয়োজন করা হয়। পালার সময়সীমা নির্ধারিত হয় আয়োজকের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে। পুরো পালা ব্যয়বহুল তাই অনেকে একদিন, তিনদিন বা পাঁচ দিনের পালা আয়োজন করে। সাধারণত রাতের খাবারের পর পালা শুরু হয়, মধ্যরাতে পালা শেষ করা হয়। ভোরবেলা শুরু হয়ে দুপুর পর্যন্ত পালা পরিবেশিত হয়।
ভূমি সমতল মঞ্চে ‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশিত হয়। মঞ্চের উপর আচ্ছাদন হিসেবে কাপড় বা ত্রিপল ব্যবহার করা হয়। চারপাশে বাঁশের খুঁটি দিয়ে এই কাপড় লাগানো হয়। সাধারণত ১২ বর্গফুটের মঞ্চ তৈরি করা হয়। তবে স্থান ভেদে এর আকার ছোট হতে পারে। পরিবেশনার স্থান ছোট হলে মঞ্চও ছোট করা হয়। মঞ্চে কোনো কিছু বিছানো হয় না, ভূমিতে পরিবেশিত হয়। দর্শকের জন্য চেয়ার বা ত্রিপলের ব্যবস্থা থাকে। আবার কোথাও কোথাও দর্শক নিজেই বসার উপকরণ সঙ্গে নিয়ে আসেন। কোনো কোনো পরিবেশনায় দর্শক অর্থের বিনিময়ে চেয়ারে বসে উপভোগ করে।
দিনে আসর আয়োজিত হলে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয় না, সূর্যালোকে পালা পরিবেশিত হয়। তবে রাতের বেলা আসর হলে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়। হ্যাজাকের আলো অথবা হ্যালোজেন বাতি দুই পাশে লাগিয়ে পরিবেশন স্থানকে আলোকিত করা হয়। কখনো কখনো এর জন্য ব্যাটারি বা জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে টিউবলাইট ব্যবহার করা হয়। চৌকোণ মঞ্চের তিনদিকে দর্শক বসে পালা উপভোগ করেন। পরিবেশনকারীরা একদিক থেকে প্রবেশ করে।
পালা শুরুর আগে মঞ্চের এক কোণে মনসা দেবীর ঘট ও উপকরণ সাজানো হয়। এগুলো হলো- কলা গাছ, নতুন হাঁড়ি, গামছা, চালুনি, সাত রকমের ফল, আতপ চাল, সোয়া কেজি ধান, দুধ, ধুতি, নকশা করা কলস ও সিঁদুর। যিনি এই সাজানোর কাজটি করেন, তাঁকে বলা হয় ওস্তাদ। পালা পরিবেশনের সময়ে ওস্তাদ নিরামিষ ভোজন করেন। পালা পরিবেশনের সময় সকল পরিবেশনকারী এই সাজানো স্থানটিকে ভক্তি (প্রণাম) দিয়ে পালায় প্রবেশ করেন। পালা পরিবেশনের শেষাংশে এই উপাচারসমূহ আয়োজকের মাথায় তুলে দেওয়া হয়। একে বরণ পালা বলা হয়। যার কারণে এই আয়োজন তিনি জলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি যতটুকু পারলাম ততটুকু করলাম এ থেকে আমার বিপদ যেন কেটে যায়।’ এরপর উপাচারসমূহ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পদ্মার নাচনের আয়োজক ও পরিবেশনকারীর ধারণা ভাসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে রোগ-বালাই ও বিপদ থেকে মুক্তি ঘটে।
পরিবেশনায় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে খোল, করতাল ও মন্দিরা ব্যবহৃত হয়। ‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশনায় নৃত্য ও গীতের অংশটি নিয়ন্ত্রণ করে খোলবাদক। খোলবাদক বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করে গানের লয় নিয়ন্ত্রণ করেন। আবার দৃশ্যান্তরের সময় ‘তেহাই’ সহযোগে নতুন দৃশ্যে প্রবেশের ইঙ্গিত প্রদান করেন। কোনো কোনো দলে বাঁশি ব্যবহার করা হয়। এই বাঁশি দৃশ্যপরিবর্তনে ভূমিকা পালন করে।
গায়েন হাব-ভাবসহ গান পরিবেশন করেন। কখনো কখনো তিনি গানের তালে ঝুমুর নাচ পরিবেশন করেন। গায়েন নাচের মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাত সম্মুুখে নিয়ে আসেন। তিনি মূলত দর্শকের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার জন্য হাতের ব্যবহার করেন। ছুকরিগণ কোমর বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে এক ধরনের নৃত্য পরিবেশন করেন। একে ‘ডাইল ঘোটা’ বলা হয়। এই নৃত্য পরিবেশনের সময় নৃত্যকগণ বিরতিহীন দীর্ঘসময় কোমর বৃত্তাকারে ঘোরাতে থাকেন। মূল গায়েন ছাড়া দোহার ও ছুুকরিগণ এই নৃত্য পরিবেশন করে। সমস্ত শরীর বৃত্তাকারে ঘূর্ণনের মাধ্যমে পরিবেশনকারীরা আরেক ধরনের নৃত্য পরিবেশন করেন। একে ‘পায়রা’ বলা হয়। এই পায়রা নৃত্যের সময় নৃত্যকগণ দু’হাত প্রসারিত করে দেন। সাধারণত ছুকরিগণ এই নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। পায়রা নৃত্য পরিবেশনের শুরুতে ধীর লয়ে বৃত্তকারে ঘৃর্ণন শুরু হয়। পরবর্তীসময়ে দ্রুতলয়ে তারা বৃত্তাকারে ঘূর্ণনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য তৈরি করে। এই নৃত্যে ঘড়ির কাটার দিকে ঘূর্ণনের পর বিপরীত দিকে একই ঘূর্ণনপ্রক্রিয়া হয়।
পদ্মার নাচন পরিবেশনায় বাদ্যযন্ত্রী, গায়েন এবং পুরুষ চরিত্রের অভিনেতারা সাদা অথবা হলুদ ফতুয়া বা কোড়াগেঞ্জি বা পাঞ্জাবি এবং ধুতি পরিধান করেন। তারা কোমরে লাল ওড়না পরিধান করেন। তবে কখনো কখনো লাল ওড়নার পরিবর্তে গামছা ব্যবহার করতে দেখা যায়। নারী চরিত্র রূপদানকারী পুরুষ অভিনেতারা লাল বা কালো রঙের ব্লাউজ পরিধান করেন। তারা শাড়ি হিসেবে লাল, হলুদ বা কমলা রঙের উজ্জ্বল শাড়ি পরিধান করেন। সনেকা, পদ্মা ও বেহুলা চরিত্রে অভিনয়কারীগণ লাল রঙের জড়ির ওড়না ব্যবহার করেন।
ছুকরিগণ ছাড়া অন্য অভিনেতারা রূপসজ্জা করেন না। রূপসজ্জার উপকরণ হিসেবে আগে বিভিন্ন রঙের জিংক অক্সাইড গুড়া, সিঁদুর, কাজল ও জরি ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে জিংক অক্সাইড গুড়ার বদলে প্যানকেক ও ফাউন্ডেশন ব্যবহার করেন। প্রত্যেক নারী চরিত্র রূপদানকারী কানে দুল ব্যবহার করে। এছাড়া এক পায়ে ঘুঙুর ব্যবহার করা হয়। নারী চরিত্রকে বাস্তবানুগ করার জন্য খোঁপায় কাগজ বা প্লাস্টিকের ফুল পরিধান করতে হয়। লিপস্টিক ও আইশ্যাডোও ব্যবহার করা হয়। অভিনেতারা নারী চরিত্রেকে ফুটিয়ে তোলার জন্য চোখে অতিরিক্ত পাপড়ি, ভ্রু চিকন করা, নাক ও কানে অলঙ্কার পরার জন্য ফুটো করে থাকে। ছুকরিগণ গলায় পুঁতির মালা পরে।
পোশাক বিষয়ে এক সাক্ষাৎকার পরিবেশনকারী দলের সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নায়ক নায়িকাদের পোশাকে হলুদ রং থাকলে ভালো হয়।’ হলুদ রঙ ব্যবহারের কোনো কারণ তিনি জানেন না। গায়েনের হাতে চামর থাকে। এই চামর তিনি বিশ্রাম নেওয়ার সময় অন্যজনের হাতে দেন, তখন গায়েন চরিত্র বদলে যায়। যিনি চামর হাতে নেন তিনিই তখন মূল গায়েনের দায়িত্ব পালন করেন। গায়েনের সংলাপ, বর্ণনা ও গান সহযোগে এই উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শক উপলব্ধি করে যে তারা থিয়েটারেই আছে।
‘পদ্মার নাচন’ পরিবেশনার কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই, অভিনেতা কতকক্ষেত্রে নিজে সংলাপ রচনা করেন। একই দলের একটি পরিবেশনার সঙ্গে অন্য পরিবেশনার মিল নেই। পরিবেশনকারী ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে সংলাপ তৈরি করেন, আবার সংলাপ প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রেও দুটি পরিবেশনায় ভিন্ন চিন্তাপ্রসূত হয়ে প্রক্ষেপণ আলাদা হয়ে যায়। এ বিষয়ে পরিবেশন দলের সদস্য বলেন, ‘আমরা পালার সময় দর্শকের কথা ভাবি, দর্শকের মনের কাছে যেতে চাই, তাই তাদের খুশি করার জন্য সংলাপ ও গানের শব্দ বদলে দেই।’
এই পরিবেশনায় অভিনয়ের শক্তিই প্রধান। এখানে মঞ্চে কোনো সেট, আলোকের কারসাজি কিংবা প্রপস থাকে না। অভিনেতার উড়নি/গামছা আর মূল গায়েনের চামরই এখানে নানা রূপে ব্যবহৃত হয়। চাঁদ সওদাগর যখন দাই-এর বাড়িতে যায় তখন শূন্য স্থানকে বাড়িতে রূপান্তরিত হয় অথবা বেহুলা-লখিন্দরের লোহার বাসর ঘর দেখানোর জন্য পরিবেশন স্থানের বদল ঘটানো হয় না। তারা মঞ্চে শুয়ে থাকেন। আলো কমানো বা বাড়ানো হয় না।
বাঙালির হাজার বছরের পথচলায় এমনি নানা পরিবেশনার তথ্য পাওয়া যায়। এই পরিবেশনাসমূহ বাঙালির ঐতিহ্যকে নানা নির্যাতনের বিপ্রতীপে টিকিয়ে রেখেছে। জয় হোক পদ্মার নাচন পরিবেশনার।
লেখক: নাট্যকার, গবেষক, সহকারী অধ্যাপক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
তারা//