ঢাকা     মঙ্গলবার   ২০ মে ২০২৫ ||  জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩২

অস্তিত্ব সংকটে বাগেরহাটের মৃৎশিল্প

মো. শহিদুল ইসলাম, বাগেরহাট || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৮, ১৯ এপ্রিল ২০২৫   আপডেট: ১৬:০৭, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
অস্তিত্ব সংকটে বাগেরহাটের মৃৎশিল্প

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প মৃতশিল্প। ছবি: লেখক

‘একটি চাকা ঘুরছে, আর সেই চাকার ওপর শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের হাঁড়ি, পাতিল, খেলনা’— একসময় এই দৃশ্য ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কুমারপাড়াগুলোর সাধারণ চিত্র। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই মৃৎশিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে।  

বাগেরহাট সদর উপজেলার তালেশ্বর কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পীদের গল্পটাও ভিন্ন নয়। এখানকার প্রায় ১৫টি পরিবার এখনও মাটির তৈজসপত্র তৈরির কাজে যুক্ত, যদিও একসময় এই শিল্পে যুক্ত ছিল ২০০টির বেশি পরিবার। এখন এই শিল্পীরা জীবন-জীবিকার জন্য অন্য পেশার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন।

তালেশ্বর কুমারপাড়ার প্রবীণ মৃৎশিল্পী রবিন পাল জানান, “মাটির জিনিস তৈরির জন্য বিশেষ ধরনের মাটি লাগে, যা বরিশাল থেকে সংগ্রহ করতে হয়। যেকোনো মাটিতে এই জিনিস তৈরি করা যায় না। আগে আমরা আমাদের নিকটবর্তী নদীর চরের মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করতাম এখন দূষণের ফলে আর আমাদের বাড়ির কাছের মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করতে পারছি না। আমাদের এখানে মাটি প্রস্তুতের জন্য কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। আমরা এখনো হাত-পা দিয়েই সনাতন পদ্ধতিতে মাটি মেখে প্রস্তুত করি।”

তিনি জানান, মাটির তৈরি জিনিসের উৎপাদন প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য। মাটি চাকার ওপরে বসিয়ে থালা, বাটি, দইয়ের মালশা, পানির পাত্রসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। এরপর সেগুলো রোদে শুকানো হয়, লাল মাটির তরলের মধ্যে ডুবিয়ে রঙ করা হয়, এবং পরবর্তীতে একসাথে পুড়িয়ে বাজারজাত করা হয়।

কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় লাভ যে খুব সামান্য, তা রবিন পালের কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, “এক মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ করলে লাভ থাকে মাত্র ৮ হাজার টাকার মতো। পরিবারের সবাই মিলে দিন-রাত পরিশ্রম করেও তেমন কিছু থাকে না। দোকানদাররা আমাদের কাছ থেকে ১০ টাকায় যে মালামাল কেনে, সেটাই ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করে। ফলে প্রকৃত শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।”

প্রবীণ আরেক মৃৎশিল্পী খগেন পাল বলেন, “আমি বিএ পাস করার পরও চাকরির দিকে না গিয়ে এই পেশায় আসি, কারণ তখন এর ভালো চাহিদা ছিল। আমাদের হাতের তৈরি মাটির জিনিসপত্র একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হতো। পাশের নদী দিয়ে নৌকা বোঝাই করে মালামাল পাঠানো হতো। কিন্তু এখন সেটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তো আমাদের গ্রামেই মাটির হাঁড়ি-বাটি নেওয়ার লোক পাওয়া যায় না।”

এই শিল্পকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তুলতে সরকারি সহায়তার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। খগেন পাল বলেন, “বিদ্যুৎচালিত চাকা পেলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হতো। এতে নতুন প্রজন্মেরও আগ্রহ তৈরি হতে পারত। আমাদের এলাকার কয়েকটি পরিবার বিদ্যুৎ চালিত চাকায় কাজ করে। হাতে চালিত বড় চাকায় কাজ করতে অনেক কষ্ট হয় তাই এখন আর কেউ এই কাজ শিখতে চায় না, কারণ এতে কষ্ট বেশি আয় কম।”

দীপালী রানী পালও একজন মৃৎশিল্পী। ছোটবেলা থেকে বাবার বাড়িতে বসে মাটির কাজ করতেন, এখন স্বামীর বাড়িতেও তাই করেন। তিনি বলেন, “মাটির হাঁড়ির পানি ঠান্ডা থাকে, মাটির পাত্রে রান্না করলে খাবারের স্বাদ আলাদা হয়। কিন্তু মানুষ এখন প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম আর মেলামাইনের দিকে ঝুঁকেছে। এতে শুধু আমাদের কাজ কমেনি, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে।”

তিনি আরও জানান, এখন ব্যবসায় লাভ কমে গেছে বলে নতুন করে কেউ আর এই পেশায় আসতে চায় না। কষ্ট এবং অলাপ জনক হওয়ায়  অনেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। হয়তো ১০-১৫ বছর পর এই গ্রামে আর কোনো মৃৎশিল্পীই থাকবে না।”

তালেশ্বর গ্রামের শেখর চন্দ্র পাল বলেন, ‘‘বাড়িতে বসে যে মালামাল তৈরি করি সেগুলো পাইকারদের কাছে বিক্রির পাশাপাশি কোথাও মেলা হলে সেখানে নিয়েও বিক্রি করি। পলিথিন ও প্লাস্টিকের প্রভাবে আমাদের এই পণ্যের চাহিদা কমেছে। মেলাতেও এখন বেচাকেনা কমে গেছে। এখন ফুলদানি, ডিনার সেট, চায়ের কাপ সহ মাটির তৈরি কিছু সৌখিন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্রচারের অভাবে মালামাল বিক্রি হচ্ছে না। আমি এই পেশায় ৩০ বছর ধরে আছি। আমার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে অন্য পেশায় দিতে চাই। এই পেশার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’’

তালেশ্বর কুমারপাড়ার কিছু পরিবার এখন প্রতিমা তৈরির কাজেও যুক্ত রয়েছেন। তাদের মধ্যে কমলা পাল জানান, “সরস্বতী ও দুর্গাপূজার সময় আমাদের কাজের চাপ বাড়ে। তখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ প্রতিমার অর্ডার দিতে আসে। কিন্তু বছরজুড়ে তেমন কাজ থাকে না। তাই অনেকেই বিকল্প কাজ বেছে নিচ্ছে।” 

এই গ্রামের কুমার পাড়ায় বর্তমানে ১৫টি পরিবার মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখলেও, কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, কেউ বা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তালেশ্বর কুমারপাড়ার বাসিন্দা উজ্জ্বল পাল যেমন পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছেন। তিনি বলেন, “এক সময়ে আমাদের পাশের নদীতে বড় বড় নৌকা আসতো মাটির তৈরি মালামাল নিতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে নৌকা আসতো। এখন আর সেই বেচাকেনা নেই। অনেক চেষ্টা করলাম এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু লাভ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিলাম। এখন বাইরে শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে চাষবাসের কাজ করি।” 

স্থানীয়দের আশা, যদি মানুষ আবার মাটির তৈরি জিনিসের দিকে ফিরে আসে, যদি পরিবেশ রক্ষার জন্য এই পণ্যকে জনপ্রিয় করা হয়, তাহলে হয়তো আবারো কুমার পাড়ার ঘরে ঘরে চাকা ঘুরবে মৃৎশিল্পের।

স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষক দীপক কুমার পাল বলেন, “মাটির তৈরি পণ্য একসময় আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল। কালের বিবর্তনে এই শিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পরিবেশবান্ধব হওয়া সত্ত্বেও প্লাস্টিকের আধিপত্যে এই পণ্য হারিয়ে যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, ‘‘এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে মৃৎশিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। কম সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে, যাতে তাঁরা বড় পরিসরে উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারেন। মাটির তৈরি পণ্যকে বাজারজাত করার জন্য সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিক ও মেলামাইনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।"

বাগেরহাট বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মোঃ শরীফ সরদার বলেন, ‘‘বাগেরহাটের তালেশ্বরে পাল পাড়াতে স্থানীয় কিছু পরিবার এখনো মাটির তৈজসপত্র তৈরি করছে। বংশপরম্পরায় এই কাজ তারা করছে। এটি আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প। বর্তমান সময়ের সাথে তারা আধুনিকায়ন হতে না পারায় এই শিল্প অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। যদিও মাটির তৈরি জিনিসপত্রের এখনো চাহিদা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিসিক এর পক্ষ থেকে তাদেরকে সহায়তা করার সুযোগ রয়েছে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিসিক এর পক্ষ থেকে তাদেরকে প্রশিক্ষণেরও সুযোগ রয়েছে। তাদের যদি আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হয়, ঋণের প্রয়োজন হয় সেটিরও ব্যবস্থা বিসিক করবে। তারা যদি মনে করে তাদের পণ্যটির মার্কেটিং প্রয়োজন সে ক্ষেত্রেও আমরা তাদের পাশে থাকবো।’’

ঢাকা/লিপি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়