সুমুদ ফ্লোটিলার ‘মাত্র চারটি নৌকা’ এখন গাজার পথে
ত্রাণ পৌঁছে গাজার অবরোধ ভাঙার শপথ নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উপকূলে আসামাত্রই গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার একের পর এক নৌযান নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ট্র্যাকারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪৪টি নৌকার বহরের প্রায় সবই ইসরায়েল ‘কব্জা করেছে’ অথবা ‘কব্জা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে’। ক্রমেই লাইভ ট্র্যাকিংয়ের চিহ্নগুলোর রং বদলে যাচ্ছে, কয়েকটি বাদে সব নৌকার অবস্থানকে লাল বৃত্তে চিহ্নিত চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সুমুদ ফ্লোটিলা ট্র্যাকার দেখাচ্ছে, মাত্র চারটি নৌযান রয়েছে, যেগুলো ইসরায়েল এখনো জব্দ করেনি এবং গাজার পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সুমারটাইম-জং ও শিরিন নামে নৌযান দুটি আইনি সহায়তাকারী নৌকা।
ট্র্যাকারে দেখাচ্ছে, মিকেনো নামে নৌকাটি প্রথম গাজার জলসীমায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয় এবং সেটি চলমান রয়েছে। মেরিনেট নামে আরেকটি নৌকা এখনো গাজার পথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে।
এর আগে আলজাজিরার খবরে বলা হয়, ফ্লোটিলার মোট ৪৪টি নৌকার মধ্যে ২১টিই ইসরায়েলি বাহিনী জব্দ করেছে এবং সেগুলোর কোনোটি আশদোদ বন্দরে ভেড়ানো হয়েছে বা কোনোটি বন্দরে নেওয়া হচ্ছে।
গাজার অবরোধ ভাঙার লক্ষ্যে ৪৬টি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ৪৯৮ জন অধিকারকর্মী ৪৪টি নৌকা নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গাজার পথে যাত্রা শুরু করে। গাজায় গণহত্যা নিয়ে নীবরতা ভেঙে ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে আসতে চাপ দিতে থাকে বিভিন্ন দেশ, যার ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়; আরো অনেক দেশ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
তবে রাজনীতি-কূটনীতির জটিল প্যাঁচ পাশ কাটিয়ে বিশ্বের অধিকারকর্মীদের একটি গ্রুপ গাজায় ইসরায়েলের নজিরবিহীন অবরোধ ভাঙার অঙ্গীকার করে নৌযানের বহর নিয়ে গাজার দিকে যাত্রা করে দুদিন আগে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে নৌযানগুলোর অবস্থান গাজার উপকূল বা তার কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। তবে আন্তর্জাতিক জলসীমাতেই সেগুলোর বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরায়েলি হানাদার বাহিনী।
শেষ পর্যন্ত সুমুদ ফ্লোটিলার কোনো নৌকা গাজার অবরোধ ভাঙতে পারবে কি না, সেটিই দেখার বিষয়।
সুমুদ ফ্লোটিলার কনসিয়েন্স নামে নৌযানে আছেন বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। ঝঞ্ঝামুখর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বার্তা দিয়েছেন তিনি।
নৌকার ভেতরের একটি ছবি ফেসবুকে দিয়ে শহিদুল আলম লিখেছেন, “নৌকার ভেতরে ঘুমানোর স্থান এই জায়গাটি। জাহাজে ওঠার সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে আমার এখানে কোনো জায়গা ছিল না। গত রাতটা আমি খোলা ডেকেই ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু বাইরে ঝড় থাকার কারণে সেই সুযোগও আর ছিল না। বের হওয়ার গেটের পাশে একটি ছোট্ট জায়গা খুঁজে পেলাম। সেখানে শব্দ ছিল এবং আলো জ্বলজ্বল করছিল, কিন্তু পূর্বে আটক ও কারাবাসে থাকার সময় আমার সেইসব অবস্থার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল; ফলে আমি গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিলাম।”
এরপর তিনি লিখেছেন, “বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শুভকামনা ও প্রার্থনার বার্তা আসছে। আমি দুঃখিত সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে জবাব দিতে পারছি না, তবে আমি আপনার অভিনন্দন ও প্রার্থনা আমার সাথীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এটা সত্যিই অনেক বড় প্রভাব ফেলে।”
পূর্বাপর
এর আগে আলজাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, ফ্লোটিলার অধিকারকর্মীরা ফিলিস্তিন স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাদের নৌকার পাল উড়িয়ে রাখবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।
ফ্লোটিলার মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) ভোরে এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লেখেন, গাজার পথে মিশন ‘দৃঢ়ভাবে অগ্রসরমান’। তবে ট্র্যাকারে সেই চিত্র আর অব্যাহত দেখা যাচ্ছে না; মাত্র চারটি নৌযান এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছে বলে ধরা হচ্ছে।
সুমুদ ফ্লোটিলা ট্রাকারে দেখা যাচ্ছে, অন্তত একটি নৌকা গাজার জলসীমায় প্রবেশ করেছে। তবে সেটি ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। এর পেছনে আর যে নৌযানগুলো আসছিল, সেগুলোর অধিকাংশ এখন ইসরায়েলি বাহিনীর কব্জায়।
ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, ফ্লোটিকার কাউকে গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আর অধিকারকর্মীরা বলছেন, তারা গাজায় প্রবেশের জন্য প্রাণ বাজি রেখেছেন।
সুমুদ ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিকারকর্মী, রাজনীতিক, কূটনীতিক ও জলবায়ুকর্মী মিলে পাঁচ শতাধিক মানুষ।
এই অধিকারকর্মীদের মধ্যে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু আন্দোলনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত গ্রেটা টুনবার্গ রয়েছেন, যাকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি হানাদারা বাহিনী। তাকে গ্রেপ্তারের মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
এই ফুটেজ ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ছাড়া হয়; সেখান থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংগ্রহ করেছে। ভিডিওতে গ্রেটার সঙ্গে তার সহযোগীদের দেখা গেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, গ্রেটা ও তার বন্ধুরা ভালো আছেন, নিরাপদে আছেন।
ইসরায়েলের গণহত্যা অভিযানে গাজার অন্তত ৬৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, গুরুতর আহত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়ছেন প্রায় দেড় লাখ। বহু শিশু অনাহার-অর্ধাহারে মায়ের কোলে মারা যাচ্ছে, কঙ্কালসার সন্তান প্রসব করছেন গাজার মায়েরা। আর সব বয়সি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে ধুকছে।
শুরুর দিকে বিশ্ব সম্প্রদায় নিশ্চুপ থাকলেও কয়েক মাস হলো ইউরোপ, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিক ও আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সহ অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থনে এখনো গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। শহিদুল আলমের মতো বিশ্বের ৪৬টি দেশের অধিকারকর্মীরা যখন গাজা ফ্লোটিয়া নিয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন এবং অধিকাংশ দেশ যখন এই ফ্লোটিলার পক্ষে রয়েছে, তখনো গাজায় নরহত্যা অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরায়েল।
আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, বুধবারও (১ অক্টোবর) গাজায় ৯৩ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
অবশ্য গাজা ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হানার প্রতিবাদে দেশে দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনা ও ইতালিতে বিশাল র্যালি হয়েছে। মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ইসরায়েলের নিন্দা করে অধিকারকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কলম্বিয়া থেকে ইসরায়েলের সব কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং কালবিলম্ব না করে তাদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কলম্বিয়া সরকার।
সিএআইআরের নিন্দা
দি কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) গাজার উদ্দেশ্যে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য সহায়তা নিয়ে যাত্রাকারী কর্মীদের ওপর ইসরায়েলি নৌবাহিনীর অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
সিএআইআরের উপ-নির্বাহী পরিচালক এডওয়ার্ড আহমেদ মিচেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আবার ইসরায়েলি দখলদারিত্ব দেখিয়ে দিল, তারা মানবিক কর্মীদের অপহরণ করবে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় দস্যুতা চালাবে; সবই ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর তাদের অবৈধ অবরোধ বজায় রাখার জন্য।”
তিনি আরো বলেন, “যেকোনো দেশ, যারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আনুগত্যের দাবি করে, তাদের উচিত গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওপর এই অবৈধ হামলাকে নিন্দা জানানো এবং গাজার অবরোধ ভাঙতে নিজেরাই পদক্ষেপ নেওয়া। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো, যারা ইসরায়েলের গণহত্যাকে অব্যাহতভাবে সহায়তা করছে; যদিও তাদের নাগরিকরাই একে থামাতে জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে, তাদের এই চলমান যোগসাজশ স্পষ্ট করে দেয় ইসরায়েলপন্থি লবিগ্রুপগুলোর প্রভাব ও ফিলিস্তিনবিরোধী বর্ণবাদই এর কারণ।”
ফ্লোটিলা জব্দ করা গুরুতর অপরাধ: দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার নৌকাগুলো জব্দ করা ইসরায়েলের গুরুতর অপরাধ, যা গাজার দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যে বিশ্বসংহতি ও মানবিক চেতনার বিরুদ্ধে গেছে।
রামাফোসা ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়েছেন, ফ্লোটিলায় থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে, যার মধ্যে আছেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি এনকোসি জ্ওয়েলিভেলিলে ম্যান্ডেলা।
তিনি বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে যেন এই ফ্লোটিলায় বহন করা জীবনরক্ষাকারী পণ্য গাজার মানুষের কাছে পৌঁছায়, কারণ এই ফ্লোটিলা গাজার সঙ্গে সংহতির প্রতীক, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের নয়।”
“আমার চিন্তা-ভাবনা সব অপহৃত ব্যক্তিদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে রয়েছে এবং আমার প্রত্যাশা, ইসরায়েল মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তি দেবে, কারণ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে এসব অপহরণের কোনো যৌক্তিকতা নেই,” বলেন রামাফোসা।
ঢাকা/রাসেল